বছর শেষে তিন ভারতীয় সিনেমায় মজেছেন বাংলাদেশি দর্শকেরা। গত বছর হিন্দি সিনেমার জন্য দারুণ একটা বছর ছিল। ‘পাঠান’, ‘জওয়ান’-এর মতো ব্যবসাসফল সিনেমা যেমন মুক্তি পেয়েছে, তেমনি দেখা গেছে ‘গুলমোহর’, ‘খুফিয়া’র মতো প্রশংসিত সিনেমাও। তবে বছরের শেষ ভাগে এসে চমকে দিয়েছে তিনটি সিনেমা। গত সপ্তাহে ওটিটিতে মুক্তির পর ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হচ্ছে ছবিগুলো। জেনে নেওয়া যাক সিনেমাগুলোর সম্পর্কে বিস্তারিত।
‘টুয়েলভথ ফেল’
গত ২৭ অক্টোবর প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় বিধু বিনোদ চোপড়ার সিনেমাটি। গত ২৯ ডিসেম্বর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ডিজনি প্লাস হটস্টারে মুক্তির পর বাংলাদেশি দর্শকেরা মজেছেন ‘টুয়েলভথ ফেল’।
‘মুন্না ভাই’ ফ্র্যাঞ্চাইজি, ‘থ্রি ইডিয়টস, ‘পিকে’ অথবা ‘সঞ্জু’ সিনেমার প্রযোজক হিসেবেই অনেকে তাঁকে চেনেন। তবে বিধু বিনোদ চোপড়া কেবল প্রযোজকই নন, ‘পারিন্দা’, ‘১৯৪২: আ লাভ স্টোরি’র মতো সিনেমার পরিচালকও বটে। নন্দিত এই নির্মাতা-প্রযোজকের নতুন সিনেমা ‘টুয়েলভথ ফেল’।
গল্প ডাকাতের জন্য কুখ্যাত রাজস্থানের চম্বল এলাকার। নিয়মের ‘ন’ বলতে নেই সেই এলাকায়। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা থেকে সর্বত্রই ঘুষের কারবার। এমনকি নিশ্চিত ফেল করবে জেনে শিক্ষকেরা ‘দয়াপরবশ’ হয়ে শিক্ষার্থীদের নকল করতে সহায়তা করেন! পাস তো অন্তত করুক। এই গ্রামের ছেলে মনোজ কুমার শর্মা। তার স্বপ্ন বড়।
কিন্তু এত অনিয়ম আর অভাব-দারিদ্র্যের মধ্যে তার স্বপ্ন কি সত্যি হবে? স্বপ্নপূরণের একটা সুযোগ আসে, দাদি সারা জীবনের সঞ্চয় তুলে দেন মনোজের হাতে। নাতি রওনা হয় দিল্লিতে। স্বপ্ন, সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উতরে গিয়ে পুলিশ অফিসার হবে। কিন্তু ভাগ্য যে তার জন্য এতটা পরীক্ষা লিখে রেখেছে, কে জানত। দিল্লিতে গিয়েই সব টাকা হারিয়ে ফেলে মনোজ। এরপর কী হয়? চম্বলের মনোজ কি পারে পুলিশ হওয়ার স্বপ্ন সত্যি করতে? এই নিয়েই ‘টুয়েলভথ ফেল’ সিনেমার গল্প।
সিনেমাটি তৈরি হয়েছে অনুরাগ পাঠকের একই নামের বহুল পঠিত বই অবলম্বনে, যা লেখা হয়েছিল সত্য ঘটনা অবলম্বনে। বেশির ভাগ সমালোচকই বলছেন, অনেক দিন পর এমন হিন্দি সিনেমা তৈরি হয়েছে, যা ভারতের শিকড়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। সমালোচকেরা মনোজের চরিত্রে অভিনয় করা বিক্রান্ত ম্যাসির ব্যাপক প্রশংসা করেছেন। তিনি যে সিনেমাটিতে ক্যারিয়ার–সেরা অভিনয় করেছেন, সে বিষয়েও একমত সমালোচকেরা।
সাধারণ দর্শকও লুফে নিয়েছেন সিনেমাটি। প্রত্যন্ত এক গ্রামের প্রায় নিঃস্ব এক তরুণের আইপিএস অফিসার হওয়ার গল্প সাধারণ মানুষকেও ছুঁয়ে গেছে। ফলে তেমন কোনো প্রচার ছাড়াই মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে ‘টুয়েলভথ ফেল’-এর গল্প।
‘খো গায়ে হাম কাঁহা’
অভিনেত্রী হিসেবে অনন্যা পাণ্ডে প্রশংসা পেয়েছেন এমনটা খুব বেশি হয়নি। গত বছর শকুন বাত্রার ‘গেহরেইয়া’তে অভিনয় করে প্রশংসিত হন। সে ছবিতে অনন্যা অভিনীত চরিত্রটি ছিল বাস্তবের অনন্যার মতোই। ভিন্নধর্মী চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি যেমন তারিফ পেয়েছেন, যোয়া আখতার-রীমা কাগতির চিত্রনাট্যে অর্জুন বারাইন সিং পরিচালিত পুরো সিনেমাটিই অন্তর্জালে জনপ্রিয়তায় প্রথম দিকে রয়েছে।
এই ওয়েব ফিল্মটির গল্প তিন স্কুলের বন্ধু ইমাদ আলী, অহনা সিং ও নীল পেরেইয়াকে নিয়ে। একজন স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান, একজন হার্ভার্ড থেকে স্নাতক শেষ করেছে আর অন্যজন ট্রেনার। তিন বন্ধুর জটিল সম্পর্ক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীলতা মিলিয়ে এই সময়ের গল্প বলেছে ‘খো গায়ে হাম কাঁহা’, তরুণ সিনেমাপ্রেমীদের কাছে এ জন্য দ্রুতই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে সিনেমাটি।
জোয়া আখতার-রীমা কাগতির গল্পে অনেক সময়ই উঠে আসে সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির গল্প। তবে তাঁদের গল্পে এই শ্রেণিকে যেভাবে পাওয়া যায়, অন্যদের গল্প সেটা পাওয়া যায় কমই। কারণ, উচ্চবিত্তদের জীবনের অসহায়ত্ব, কষ্ট দারুণভাবে তুলে আনেন তাঁরা। ব্যতিক্রম নয় ‘খো গায়ে হাম কাঁহা’ও। এ জন্যই সিনেমাটি ঠিক সিনেমা না হয়ে বাস্তবের গল্প হয়ে ওঠে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই যুগে ‘দেখনদারি’র বিষয়টিও অপরিচিত নয়। আমি যা তার চেয়েও বেশি দেখানোর প্রবণতা অনেকের মধ্যেই আছে।
এই যেমন বলা যায় আদর্শ গৌরব অভিনীত নীল চরিত্রটির কথা। অন্য দুই বন্ধুর চেয়ে তাঁর অর্থনৈতিক অবস্থার দিক থেকেও সে কিছুটা পিছিয়ে কিন্তু বাস্তবে তা প্রকাশ করবে কেন? এ রকম ছোট ছোট বিষয়গুলো দারুণভাবে পর্দায় তুলে ধরেছেন নির্মাতা।
‘থ্রি অব আস’
গত ২৯ ডিসেম্বর নেটফ্লিক্সে মুক্তির পর সিনেমাপ্রেমীদের মন জয় করে নিয়েছে আরেকটি সিনেমা—অবিনাশ অরুণের ‘থ্রি অব আস’। অবিনাশ মূলত চিত্রগ্রাহক। তবে ‘কিল্লা’, ‘পাতাল লোক’, ‘আনপজড’-এর পর থেকে নির্মাতা হিসেবেও তাঁকে সমীহ করতে হবে।
স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত শৈলজা, ধীরে ধীরে সব ভুলে যাচ্ছে। সব ভুলে বসার আগে সে ফিরে শৈশবে, খুঁজে ফেরে হারানো ছেলেবেলা। মোটাদাগে এই হলো সিনেমার গল্প। পুরোনো সময়, পুরোনো প্রেম আর আবেগের মিশেলে নির্মিত সিনেমাটি দর্শকের মন ছুঁয়ে গেছে। অনেক দেশি দর্শক ‘থ্রি অব আস’ দেখার পর নস্টালজিয়ায় ভুগেছেন।
সিনেমাটির প্রধান তিন চরিত্রে অভিনয় করেছেন শেফালি শাহ, জয়দ্বীপ আহালওয়াত ও স্বানন্দ কিরকিরে। স্বানন্দ হিন্দি সিনেমার খ্যাতিমান গীতিকার, এ ছবিতে অভিনেতা হিসেবে পাওয়া গেছে তাঁকে।
সিনেমাটির বড় শক্তি এটি অদ্ভুত কিছু মুহূর্ত তৈরি করে যার রেশ রয়ে যায় শেষ হয়ে যাওয়ার পরও। ‘থ্রি অব আস’ সিনেমা পর্দায় সব খোলাসা করে না, বিভিন্ন দৃশ্য তৈরি করে রূপক অর্থে অনেক কিছুই বলে দেয়। ‘থ্রি অব আস’ যা বলে, তার চেয়েও বেশি বলে না।
https://bangla-bnb.saturnwp.link/%e0%a6%9f%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a6%bf%e0%a6%89%e0%a6%a1%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%9c%e0%a6%a8%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a6%af%e0%a6%bc/
উদাহরণ দিয়ে বলা যায় নাগরদোলায় চড়ার সেই দৃশ্যটির কথা। এই নাগরদোলা দিয়ে বোঝানো হয়েছে স্মৃতির সরণিতে ঘোরাকে। নাগরদোলা একটি জায়গায় গিয়ে থেমে যায়। শৈলজা ও প্রদীপ যেমনটা চেয়েছিল ঠিক সেখানেই থেমে যায় সেটা।
শেফালি শাহ ও জয়দ্বীপ আহালওয়াত আপনাকে ধন্দে ফেলে দেবে, কে কার চেয়ে ভালো অভিনয় করেছেন বলা মুশকিল। চলতি বছরের সেরা হিন্দি সিনেমার তালিকা করলে ‘থ্রি অব আস’ নিঃসন্দেহে সেরা তিনে থাকবে।