সমস্ত ধরনের প্রাণের বেঁচে থাকার জন্য পানি অপরিহার্য। পৃথিবীতে ৭০.৯% অংশ জুড়ে পানির অস্তিত্ব রয়েছে। পানি ছাড়া পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব না। একজন মানুষ পানি ছাড়া গড়ে মাত্র তিন দিন বেঁচে থাকতে পারে। শরীর সুস্থ রাখতে, চুলের সমস্যা বা ত্বকের কিংবা পাচনতন্ত্রের, সবকিছু পারফেক্ট রাখতে সঠিক পরিমাণে পানি খাওয়া খুবই জরুরি।
আমাদের দেশে সাধারণত সুপেয় এক লিটার পানি কিনতে কত খরচ হয় খুব বেশি হলে ২০ বা ৪০ টাকা। শুনলে বা জানলে অবাক হবেন বিশ্বের এমন পানিও আছে যার এক বোতলের দাম লাখ লাখ টাকা! পানির দাম যদি আকাশছোঁয়া হয়, তা হলে কিন্তু সত্যিই মুশকিল। কারণ পানি প্রাকৃতিক দান। প্রকৃতির দেওয়া জিনিসের এত দাম কেন, তা নিয়ে কৌতূহল ছিল অনেকেরই। অবশ্য তার রহস্য লুকিয়ে রয়েছে বোতলে।
কিন্তু এমন কী আছে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের এই মিশেলে, যার জন্য আকাশছোঁয়া দাম? এই বিলাসী পানি কখনও হয়তো সংগ্রহ করা হয়েছে হাওয়াই দ্বীপের ভলকানিক পাথর থেকে, কোনও ক্ষেত্রে তা সংগৃহীত নরওয়ের কোনও গলিত হিমবাহ থেকে বা তাসমানিয়ায় ঘাসের উপরে জমা শিশিরবিন্দু থেকে… এ ধরনের পানিকে বলা হয় ‘পিয়োরেস্ট অব পিয়োর’। তবে এই সব দামি পানির বিশেষ গুণও রয়েছে। তাই তার এত কদর। প্রকৃতির দান পানির কেন এত দাম হবে, তা নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই সাধারণ মানুষের। জেনে নিন বিশ্বের সবচেয়ে দামী পানির রহস্য ও উপকারিতা কী কী রয়েছে-
দামি পানির মধ্যে প্রথম নামটি অবশ্যই স্প্রিং ওয়াটারের। এই পানি সংগ্রহ করা হয় নদী বা ঝর্নার উৎসমুখ থেকে অর্থাৎ তা হিমবাহের বরফগলা জল, যাতে সেরা মিনারেলস পাওয়া যায় এবং তা বিশুদ্ধ। “স্প্রিং ওয়াটার সংগ্রহের বেশ কিছু নিয়ম আছে। সেই জায়গায় ওই অবস্থায় তা সংগ্রহ করতে হবে এবং বোতলবন্দিও সেখানেই করা হবে। তাই যথাযথ ভাবে নিয়ম মেনে স্প্রিং ওয়াটার সংগ্রহ করা হচ্ছে কি না এবং তা প্রকৃতই স্প্রিং ওয়াটার কি না সেটা বলা সম্ভব নয়, যদি না তা খুবই বিখ্যাত কোনও সংস্থার হয়, যারা সব সময়ে নিজেদের মান সম্পর্কে সচেতন। পুষ্টিবিদদের মতে, এই পানি অবশ্যই শরীরের জন্য খুব ভাল। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি পানির শিরোপা পাওয়া অ্যাকোয়া ডি ক্রিস্টালো ট্রিবুতো আ মোদিগিলানি। এই পানি কিন্তু স্প্রিং ওয়াটার।
‘অ্যাকোয়া দ্য ক্রিন্তালো ট্রিবুতো আ মোদিগিলানি’কে বিশ্বের সবচেয়ে দামি পানি মনে করা হয়। কারণ, এতে লুকিয়ে রয়েছে হাজারো রহস্য। এই পানিতে নাকি মেশানো রয়েছে ৫ গ্রাম ২৪ ক্যারেটের খাঁটি সোনা। এতে পানিতে ক্ষারের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। তা ছাড়া এর পানি সংগ্রহ করা হয় পৃথিবীর তিনটি স্থান যেমন: ফ্রান্সের একটি ঝরনা, ফিজি দ্বীপের একটি প্রস্রবণ এবং আইসল্যান্ডের হিমবাহ থেকে। শুধু পানি নয়, ৭৫০ মিলিলিটার পানির বোতলেও রয়েছে চমক। কারণ, এ পানির বোতল তৈরি করা হয়েছে ২৪ ক্যারেটের সোনা দিয়ে। বোতলটির নকশা করেছেন ফার্নান্দো আলতামিরানো নামে একজন জনপ্রিয় শিল্পী। এক দশক আগে এ পানির বোতলের দাম ছাড়িয়ে যায় বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৬০ লাখ। এখন এর দাম আরও বেড়েছে। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, সাধারণ মানুষের সাধ্যের অনেকটা বাইরে এই পানি। এই জলের দামের আর এক কারণ অবশ্য তার বোতলের ডিজাইন এবং প্যাকেজিং। প্ল্যাটিনামে মোড়া সীমিত সংস্করণের অসাধারণ দেখতে এই বোতলে ছ’হাজার হিরে খচিত। জলে মিশ্রিত রয়েছে তেইশ ক্যারাট ওজনের পাঁচ গ্রাম সোনার ভস্ম। অতএব বোঝাই যাচ্ছে দামের কারণ।
কোনা নিগারি পানি মানুষের ওজন কমাতে, শক্তি জোগাতে এবং ত্বকের গুণমান সমুন্নত রাখতে সাহায্য করে বলে বলা হয়ে থাকে। সমুদ্র পৃষ্ঠের এক হাজার ফুট নীচে হাওয়াই দ্বীপ থেকে এ পানি সংগ্রহ করা হয়। এ পানি অন্যান্য ব্যয়বহুল বোতলজাত পানির চেয়ে বেশি তৃষ্ণা মেটাতে সক্ষম এ পানি আরও বেশি তৃপ্তিদায়ক বলে বিবেচনা করা হয়। অনেক প্রখ্যাত চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ এবং ফিটনেস প্রশিক্ষকরা এ পানি পান করতে সুপারিশ করে থাকেন। ৭৫০ মিলিলিটারে এক বোতল পানি ৪০২ ডলারে বিক্রি হয়।
ফিলিকো পানি সুস্বাদু। দাবা খেলার গুটির সঙ্গে পরিচয় থাকলে খুব সহজেই ফিলিকোর বিশেষভাবে ডিজাইন করা বোতলগুলি চেনা যাবে। নকশায় রাজকীয় ভাব বজায় রাখতে এর বোতলের নকশা করা হয়েছে দাবার রাজা এবং রানীর গুটির মতো করে। স্বরভস্কি ক্রিস্টালের কাচের বোতল দেখতে বেশ মার্জিত এবং এর পানিও খুব স্বুস্বাদু। এ পানি সংগ্রহ করা হয় জাপানের কোবের নুনোবিকি নামে পরিচিত অতি বিশুদ্ধ ঝর্ণা থেকে। এ পানির ৭৫০ মিলিমিটারের বোতলের দাম রাখা হয়েছে ২১৯ ডলার।
ব্লিং এইচ২০ পানি অত্যাধুনিক রেস্তোরাঁয় পাওয়া যায়। ব্লিং ওয়াটার যেখান থেকে আসে ঠিক সেখানেই বোতলজাত করা হয়। টেনেসির গ্রেট স্মোকি পর্বতমালার গোড়ায় অবস্থিত ইংলিশ মাউন্টেন ঝর্ণা থেকে এ পানি সংগ্রহ করা হয়। এ পানির স্বাদ অক্ষুন্ন রাখতে ৯ টি পর্যায়ে পরিশোধন করা হয়। এ পানি অত্যাধুনিক রেস্তোরাঁ, স্পাগুলিতে পরিবেশন করা হয়। ব্লিং-এর বোতল খোলার অভিজ্ঞতা অনেকটা দামি শ্যাম্পেনের বোতল খোলার মতো। এর প্রতিটি ৭৫০ মিলিলিটার বোতলের দাম রাখা হয়েছে ৪০ ডলার।
ভিনের পানি এসেছে ফিনল্যান্ড থেকে। একে বিশ্বের সবচেয়ে বিশুদ্ধ এবং সতেজ পানির অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যে ঝর্ণা থেকে এ পানি সংগ্রহ করা হয় সেটি ফিনিশ ল্যাপল্যান্ডের কাছে অবস্থিত। ফিনল্যান্ডের প্রাকৃতিক আর্কটিক অঞ্চল বলে পরিচিত কোনিসাজো ঝর্নায় পৌঁছানোর আগে এ পানি প্রাকৃতিকভাবে বেশ শীতল পরিবেশের মধ্য দিয়ে ফিল্টার করা হয়। এরপর এ পানি সংগ্রহ করা হয়। তৃষ্ণা মেটাতে এর অস্বাভাবিক গুনসহ আরো বেশ কিছু কারণে এ পানিকে বিশেষ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এর ৭৫০ মিলিলিটারের বোতলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ ডলার।
১০ হাজার বিসি পানি, সুদৃশ্য এ বোতলজাত পানির উৎস হচ্ছে কানাডার উপকূলীয় অঞ্চল। মানবীয় দূষণ থেকে এ পানির উৎস এত দূরে যে, কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার হ্যাট পর্বতের এ হিমবাহে পৌঁছাতে সময় লাগে তিন দিন। এ পানির কোম্পানির প্রথম লক্ষ্য ছিল হিমবাহ থেকে সংগ্রহ করা পানি বোতলজাত করে বিক্রি করা। অত্যন্ত পরিশীলিত, বিলাশবহুল এবং বিশ্বমানের ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত এ পানির প্রতিটি ৭৫০ মিলিলিটারের বোতল বিক্রি হয় ১৪ মার্কিন ডলার।
অ্যাকোয়া ডেকো পানি সবচেয়ে ব্যয়বহুল। ডেকো শব্দের অর্থ শৈল্পিক। পানির বোতল হিসেবে এ বোতলের শেল্পিক সৌন্দর্য্য সেটাই প্রমাণ করে। মানুষের হাতের ছোঁয়া কানাডার একটি বিশুদ্ধ ঝর্ণা থেকে এ পানি দৃষ্টি নন্দন চমৎকার এ বোতলে সংগ্রহ করা হয়। ২০০৭ সালে এ পানি সেরা নন-কার্বনেটেড পানীয়ের স্বীকৃতি হিসেবে স্বর্ণপদক জয় করেছিল। বিলাসি পানি পায়ীদের কাছে এ পানির বিশেষ বিশেষ কদর রয়েছে। বিলাশবহুল রেস্তোরাঁ, হোটেল এবং স্পাতে বিক্রি হওয়া বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বোতলজাত এ পানির দাম রাখা হয়েছে ৭৫০ মিলিলিটারের বোতল ১২ মার্কিন ডলার।
ডিস্টিলড ওয়াটার পানি ফুটিয়ে বাষ্পে পরিণত করা হয়। তার পর সেই বাষ্পকে ফের পানিতে পরিবর্তিত করা হয়। এর ফলে এর মধ্যে কোনও মিনারেলস থাকে না। এই পানি খেলে কোনও রকম পেটের সমস্যা হবে না। কিন্তু ক্রমাগত যদি শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় খনিজবিহীন ডিস্টিলড ওয়াটার খাওয়া হয়, তা শরীরের জন্য উপযোগী নয়।
অ্যালক্যালাইন ওয়াটার ইদানীং খুবই জনপ্রিয় হয়েছে সেলেব্রিটিদের সুবাদে। সাধারণ জলের পিএইচ লেভেলের চেয়ে অ্যালক্যালাইন ওয়াটারের পিএইচ লেভেল বেশি থাকে। তাই মনে করা হয় যাদের অ্যাসিডিটির সমস্যা খুব বেশি তারা অ্যালক্যালাইন ওয়াটার খেলে ভাল থাকবেন। হয়তো সাময়িক ভাল থাকেন। কিন্তু আমাদের শরীরের পিএইচ ব্যালান্স ঠিক রাখার যে নিজস্ব ক্ষমতা রয়েছে, নিয়মিত অ্যালকালাইন ওয়াটার খেলে তার কার্যকারিতা কিছুটা হলেও কমতে পারে। রিসার্চ বলছে না যে দীর্ঘ দিন ধরে অ্যালকালাইন ওয়াটার খাওয়া শরীরের জন্য ভাল। এতে কিছুটা হলেও মিনারেলস থাকে, তবে তা যে শরীরের জন্য একশো শতাংশ ভাল, তা বলা যায় না। আবার অনেকে ভাবেন অ্যালক্যালাইন ওয়াটার ক্যানসারের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয় এবং তা বয়স ধরে রাখে— এর কোনওটিই কিন্তু এখনও পর্যন্ত প্রমাণিত নয়। অ্যালক্যালাইন ওয়াটারে মিনারেলস ইনফিউজ় করা হলে তাকে ব্ল্যাক ওয়াটার বলা হয়। এই পানিও খুবই দামি।
বাড়িতে অনেকে বোতলবন্দি মিনারেল ওয়াটারও খেয়ে থাকেন। সেটা ভাল কোম্পানির হলে তাতে বিভিন্ন মিনারেল থাকে। জীবাণু না থাকার জন্য তা থেকে পেটখারাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না, তবে তা খরচসাপেক্ষ।
শরীরের জন্য কুয়োর পানি খুবই ভাল। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে তাতে ব্যাক্টেরিয়া জন্মাচ্ছে কি না। কুয়োর পানির পিএইচ ব্যালান্স যথাযথ, মিনারেলসও রয়েছে, শুধু পরিশোধন করে নেওয়া প্রয়োজন।
এ ছাড়াও রয়েছে স্পার্কলিং ওয়াটার। এর মধ্যে সোডা দেওয়া থাকে, তাই খেতে ভাল লাগে। তবে তা কোল্ড ড্রিঙ্কের মতো নয়, এই পানিতে অতিরিক্ত চিনি বা ফ্লেভার নেই। নিয়মিত এই জল খাওয়া উচিত নয়।
যারা খুব কম পানি পান করেন বা ছোটরা অনেক সময়ে পানি পান করতে চায় না, সে ক্ষেত্রে ইনফিউজড ওয়াটার দিতে পারেন। পরিস্রুত পানিতে আনাজ বা ফলের ফ্লেভার মেশানো হয়। ফলে পানির স্বাদ বাড়ে, পানি পান করার ইচ্ছেও বাড়ে। বাড়িতে নিয়মিত পানি ইনফিউজড করে রাখলে ক্ষতি নেই, যদি না তাতে চিনি বা কৃত্রিম কোনও সুইটনার যোগ করা হয়।
সব ধরনের পানি সকলের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নেই। পানি যেন পরিস্রুত হয় এবং তাতে মিনারেলস যেন যথাযথ থাকে, খাওয়ার আগে এটুকু দেখে নিলেই যথেষ্ট। এতে পেটের গোলমাল বা অন্য রোগের ভয় থাকে না। পানি বিশুদ্ধ করার সবচেয়ে পুরানো ও কার্যকর পদ্ধতির একটি হল সেটা ফুটিয়ে নেয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, পানি ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার চেয়ে বেশি তাপমাত্রায় ৫ থেকে ২৫ মিনিট ধরে ফোটানো হলে এরমধ্যে থাকা জীবাণু, লার্ভাসহ সবই ধ্বংস হয়ে যায়। পানি ফোটানোর মাধ্যমেই ক্ষতিকর জীবাণু দূর করা সম্ভব হলেও পুরোপুরি আশঙ্কামুক্ত থাকতে ফিল্টারের মাধ্যমে বিশুদ্ধ করা যেতে পারে।