করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় এমন বহু কাজ জাদুর মতো সহজ করে দিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স সিস্টেম। চ্যাট জিপিটি-৪ এবং বার্ডের মতো লার্জ-ল্যাঙ্গুয়েজ-মডেল (এলএলএম) জেনারেটিভ এআই টুলসকে এর কৃতিত্ব দিতেই হবে। লেখা, ছবি বা ভিডিও— এআইয়ের ছোঁয়া যেখানে লাগছে সেটা করা আগের চেয়ে সহজ তো হচ্ছেই, তার চেয়েও বড় কথা হলো এআইয়ের করা কাজ আর মানুষের কাজের মধ্যে পার্থক্য করাটাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে, অনেক সময় অসম্ভবও।
যেমনটা আমরা দেখছি ও আগেই ধারণা করা হয়েছিল যে এআইয়ের এই কাজের মধ্যে ভুলের ভূত কিছু ঢুকছেই। এ কথাও অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে এই টুলগুলো অনলাইনে ভুল তথ্য তৈরি ও তা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া আগের চেয়ে অনেক সহজ করে দিয়েছে।
এআইয়ের এগিয়ে যাওয়ার এই গতি এতটাই বেশি যে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন খোদ বিশেষজ্ঞরাই। এলন মাস্ক ও স্টিভ ওজনাইকের মতো প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা কিছু দিন আগে একটি খোলা চিঠি লিখেছিলেন, যেখানে তারা আবেদন করেছিলেন— এআই ডেভলপমেন্টের কাজ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করা হোক। তারা প্রশ্ন রেখেছিলেন— যন্ত্রের হাতে এই ক্ষমতা যাওয়া উচিৎ হবে কি না যাতে প্রপাগান্ডা আর অসত্য তথ্য অবাধে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
অনলাইনে সোশ্যাল ইন্টারঅ্যাকশন নিয়ে গবেষণা করা প্রফেসর উইলিয়াম ব্র্যাডি বলছেন, এআই সিস্টেমের এগিয়ে যাওয়ার গতি যেমনই হোক না কেন আমাদের শেষ পর্যন্ত ভুল তথ্যের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতেই হবে।
ব্র্যাডি বলছেন, সায়েন্স-ফিকশন জাতীয় ইস্যুতে আমরা যেন বিভ্রান্ত না হই, সে বিষয়ে আমাদের সতর্ক হতে হবে, আর যেগুলো জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়, সেসব বিষয়ের প্রকৃত ঝুঁকি আমাদের বুঝতে হবে।
এআই-উৎপাদিত ভুল তথ্য নিয়ে সবচেয়ে ভয়ের কারণগুলো ও এরসঙ্গে বেঁচে থাকায় আমরা কিভাবে অভ্যস্ত হতে পারি সে বিষয়ে একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন ব্র্যাডি।
গুজবের চেয়ে বড় সমস্যা ভুল তথ্য
গুজব আর ভুল তথ্যের পার্থক্য নির্ণয় করা ব্র্যাডির জন্য খুব সহজ একটা কাজ। ভুল তথ্য হলো এমন তথ্য যা বিভ্রান্তিকর বা বাস্তবসম্মত নয়। আর গুজব কৌশলগতভাবে তৈরি করা হয় এবং অডিয়েন্সকে প্রতারিত করার জন্য ব্যবহার করা হয়।
ব্র্যাডি মনে করেন, এই ইস্যুতে নিজের ঝুঁকি বুঝতে হলে সবার আগে এই গুজব আর ভুল তথ্যের পার্থক্য বুঝতে হবে। যে কেউ যখন এআইয়ের সম্ভাব্য ক্ষতি নিয়ে ভাবেন তিনি মনে করেন এটা গুজব তৈরির একটা কারখানা হয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, অবশ্যই গুজব এবং ডিপফেক তৈরি এলএলএমের ফলে এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে সহজ। এ সমস্যা এখন বাড়তেই থাকবে এটা সত্যি, কিন্তু সেই সাথে এও সত্য যে এটা আরও বড় একটা সমস্যার স্রেফ একটা উপকরণ মাত্র।
ডিপফেকের উদ্দেশ্য যেহেতু মানুষকে বিভ্রান্ত করা তাই এটি সমস্যার কারণ অবশ্যই। তবে অনলাইনে এখনও ডিপফেকের পরিমাণ খুব অল্পই।
তিনি আরও বলেন, কোনো সন্দেহ নেই যে জেনারেটিভ এআই রাজনৈতিক বিভ্রান্তির বড় উত্সগুলোর একটা হতে যাচ্ছে। তবে এখন খোলা প্রশ্ন হলো এর প্রভাব পড়বে কতটা?
ব্র্যাডি মনে করছেন, সামনে দিনগুলোতে ভুল তথ্য উৎপাদন কমার পরিবর্তে উল্টো এটা চিরস্থায়ী হয়ে যেতে পারে। এলএলএমগুলোকে কোটি কোটি প্যাটার্ন দেখিয়ে এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে ভিত্তিহীন কোনো তথ্য চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় যখন এআই ছোট কোনো একটা ভুল করে, আর মানুষ সেগুলোকে এমনভাবে বিশ্বাস করে যেন তারা কোনো বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে সেই তথ্য পাচ্ছে।
এআইয়ের এগিয়ে যাওয়ার এই গতি এতটাই বেশি যে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন খোদ বিশেষজ্ঞরাই।
তিনি আরও বলেন, সবসময় পুরোপুরি ঠিক না হয়েও কিভাবে সবকিছু ঠিকঠাক থাকার একটা পরিবেশ তৈরি করতে হয় তা এআইয়ের জানা আছে।
এর অর্থ কি এটা দাঁড়ায় যে— আমরা জেনারেটিভ এআই যত বেশি ব্যবহার করব ভুল তথ্যের পরিমাণ ততই বাড়তে থাকবে? ব্র্যাডি বলছেন, এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত হয়ে এখনই কিছু বলতে পারি না। তিনি একটি গবেষণার দিকে ইঙ্গিত করেন যেখানে দেখানো হচ্ছে যে— সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়া ভুল তথ্যের পরিমাণ আসলে খুব বেশি না। কোনো কোনো হিসাবে দেখানো হয় তা পুরো ইনফরমেশন ইকোসিস্টেমের ১-২ শতাংশ মাত্র।
চ্যাটজিপিটির কারণে যেহেতু ভুল তথ্যের পরিমাণ বাড়বে, তাই হঠাৎ করে এটি ভুল তথ্যকে আগের চেয়ে বড় একটি সমস্যায় পরিণত করবে, ব্যাপারটি আসলে ঠিক সেরকম নয়। ভুল তথ্য বিস্তারের দিকে পরিচালিত করা মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো আসলে ভুল তথ্য তৈরির চেয়ে বেশি বিপজ্জনক।
অবশ্যই গুজব এবং ডিপফেক সমস্যা এখন বাড়তেই থাকবে, কিন্তু সেই সাথে এও সত্য যে এটা আরও বড় একটা সমস্যার স্রেফ একটা উপকরণ মাত্র।
ব্র্যাডি বিশ্বাস করেন ভুল তথ্যের বিস্তার সংক্রান্ত বা তা ঠেকানোর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আসলে প্রযুক্তির নিরবচ্ছিন্ন অগ্রগতি নয়, এক্ষেত্রে বরং মেশিনকে অন্ধ বিশ্বাস করার মানুষের মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতাও দায়ী।
ব্র্যাডি বলছেন যে আমরা হয়তো এআই-জেনারেটেড কনটেন্টগুলো এড়িয়ে যাব না, কারণ, আমরা সচেতনভাবে সেভাবেই চিন্তা করতে অভ্যস্ত। অন্য ভাবে বললে ব্যাপারটা দাঁড়ায় যে, ইন্টারনেটে যখন আমরা কেনো কিছু পড়ি বা দেখি, তখন সেটা নিয়ে যদি আমরা সতর্কতার সাথে চিন্তা না করি তবে আমাদের ভুল তথ্যে প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
ব্র্যাডির ভাষায়, মানুষের মনস্তত্ত্বে একটা স্বয়ংক্রিয় পক্ষপাত আছে। তাই কম্পিউটার মডেল কোনো তথ্য দিলে আমরা সেটিকে মানুষের দেওয়া তথ্যের চেয়ে বেশি সঠিক মনে করি। এর ফলে দেখা যায় যে, এআই-এর মাধ্যমে তৈরি কনটেন্টগুলোর বিষয়ে মানুষের মনে সন্দেহ কম হয়।
একটা ভুল তথ্য তখনই ছড়ায় যখন সেটা মানুষকে অনুরণিত করে এবং কোনো ধরনের প্রশ্নের উদ্রেক হওয়ার আগেই মানুষ সেটা শেয়ার করে। ব্র্যাডি বলছেন যে, এভাবে না জেনে-বুঝে ভুল তথ্য তৈরি ও ছড়ানো ঠেকাতে মানুষকে অবশ্যই আরও বেশি সচেতন হতে হবে। পুরো বিষয়টি ব্র্যাডি ‘দূষণ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ব্র্যাডি বলছেন, কোনো একটি ভুল তথ্যের সঙ্গে নিজেদের একটি বার্তা জুড়ে দিয়ে ওই ভুল তথ্যটি ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি মূলত ওই তথ্যের ভোক্তার দিক থেকেই হয়ে থাকে। যা পড়ছে, মানুষ প্রথমে সেটা বিশ্বাস করে, আর তারপর সেটা শেয়ার করে তার বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়িয়ে দেয়। তারা নিজেরা বিভ্রান্ত তো হয়েছেনই, শেয়ার করে অন্যদেরও বিভ্রান্ত করেন।
শিক্ষিত হোন
বাস্তবিক অর্থে, আমরা ভুল তথ্য রোধ করতে নিয়ন্ত্রক তদারকি বা কোম্পানির নিয়ন্ত্রণের জন্য অপেক্ষা করতে পারি না। সেটা যদি করাও হয় তবু কনটেন্ট কিভাবে তৈরি হয় ও ছড়ানো হয় তার ওপর প্রভাব কমই থাকবে। ব্র্যাডি বলছেন যে, কখন এবং কোথায় আমরা ভুল তথ্যের সম্মুখীন হতে পারি সে সম্পর্কে কীভাবে আরও সচেতন হওয়া যায় আমাদের আসলে আগে তা শিখতে হবে।
আদর্শ একটা বিশ্বে কোম্পানিগুলোর এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
কোম্পানিগুলিকে দায়িত্বশীল পদক্ষেপ নিতে হবে। যদি কনটেন্টগুলো ফ্ল্যাগড হয় তাহলে মানুষ অন্তত একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে সেটা বিশ্বাসযোগ্য কি না।
ব্র্যাডি চান ভুল তথ্য এবং জেনারেটিভ এআই নিয়েও এমন কিছুই হোক। মানুষকে ভুল তথ্য শনাক্ত করতে সহায়তা করবে এমন অনলাইন প্ল্যাটফরমের পক্ষে তিনি। কিন্তু তিনি জানেন যে, প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো এ বিষয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কোনো ভূমিকা রাখবে— তার জন্য অপেক্ষা করাটা যুক্তিযুক্ত কোনো চিন্তা নয়।
তিনি বলেন, কোম্পানিগুলো সবসময় তাদের যা করা উচিত তা করতে যে খুব একটা উত্সাহী থাকে তা নয়। আবার এটা হুট করে বদলেও যাবে না। কিন্তু আমরা মানুষকে এ বিষয়ে শেখাতে পারি।
যখন ভুল তথ্য প্রকাশের সম্ভাবনা থাকে তখন ব্যবহারকারীদের সবচেয়ে সাধারণ পরিস্থিতি সম্পর্কে পরিস্থিতিগত সচেতনতা গড়ে তোলার ফলে ভুল তথ্য প্রচারের সম্ভাবনা কম হতে পারে।
যখন কেনো ভুল তথ্য প্রকাশের সম্ভাবনা থাকে তখন ব্যবহারকারীদের মধ্যে ওই বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে পারলে ওই ভুল তথ্য ছড়ানোর আশঙ্কা কমে।
ইন্টারনেট নিয়ে সচেতনতা তুলনামূলক কম রয়েছে একটু বয়স্কদের। আর ভুল তথ্যের জন্য সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল তারাই। তাই তাদের মধ্যে ইন্টারনেট বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। চরমপন্থাসহ নির্দিষ্ট ধরনের কিছু কনটেন্ট অত্যধিক প্রচারে অ্যালগরিদম যে ভূমিকা পালন করে সে সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলা এই জনসচেতনতামূলক প্রচারণার অংশ হতে পারে।
‘এটা আসলে মানুষকে সেই প্রসঙ্গে সচেতন করে তোলা যেখানে তার ভুল তথ্যের জন্য সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল হওয়ার ঝুঁকি থাকে।’