২০২৩ সাল শেষ হতে চলল। আর কয়েক দিন পরই শুরু হবে নতুন বছর। বছরজুড়েই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি বেশ দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করেছে প্রযুক্তিবিশ্বে। এআই ছাড়াও আরও বেশ কিছু প্রযুক্তি, পণ্য ও ব্যক্তি আলোচনায় ছিলেন বছরজুড়ে। ব্যক্তি হিসেবে ইলন মাস্ক তেমনই একজন। যিনি এ বছরের প্রায় প্রতি মাসেই কোনো না কোনো কারণে প্রযুক্তিবিশ্বে আলোচনায় এসেছেন। এআই শুধু আলোচনায় থেমে থাকেনি বাড়িয়েছে উদ্বেগও।
এই উদ্বেগ তৈরি হয়েছে মূলত চ্যাটজিপিটি নামের একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বাজারে আসার পর। ভাষাভিত্তিক এই চ্যাটবট তার তথ্যভাণ্ডার বিশ্লেষণ করে প্রায় সব প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারে।
চ্যাটজিপিটি রচনা লিখতে পারে, চাকরির বা ছুটির আবেদন, যেকোনো রিপোর্ট তৈরি করতে পারে, এমনকি গান ও কবিতাও লিখতে পারে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই ক্ষমতা দেখে সারা বিশ্বের প্রযুক্তি বিষয়ক নীতি-নির্ধারক, বিনিয়োগকারী এবং নির্বাহীরা নড়ে চড়ে বসেন। এক হাজারের মতো ব্যক্তি এক খোলা চিঠিতে এই প্রযুক্তির ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, গবেষণায় এখনই রাশ টেনে না ধরলে সমাজ ও মানবজাতি বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়বে।
কেন এই ভীতি?
আয়ারল্যান্ডের একজন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ নাসিম মাহমুদ, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড হেলথ-গ্রুপের একজন প্রকৌশলী এবং এই প্রতিষ্ঠানের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করছেন, তিনি বলছেন এই ভয় অনেকটাই মানসিক।
“এটা হচ্ছে অজানাকে ভয় পাওয়ার মতো ভয়,” বলেন তিনি।
নাসিম মাহমুদ বলছেন, “ধরা যাক আমরা একটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে দায়িত্ব দিলাম প্রেসক্রিপশন লিখে দেওয়ার জন্য। সে লিখেও দিল। তার এই লেখা পর্যন্ত আমরা অনেকভাবে পরীক্ষা করে নিলাম। এর ভালো দিকটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স যদি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয় যা আমাদের বর্তমান সময়ের এথিকসের সাথে সংঘাতপূর্ণ, তখন কী হবে!”
“এই ভুল তো মানুষও করেছে। কিন্তু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে আমরা এই জায়গাতে দেখতে চাই না,” বলেন তিনি।
চ্যাটজিপিটির মতো জেনারেটিভ এআই নিয়ে উদ্বেগ ঠিক এই কারণেই। এই এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের সুলিখিত উত্তর তৈরি করা সম্ভব। এর ফলে একজন ছাত্রকে সুশিক্ষিত করে তোলার যে মূল লক্ষ্য সেটা ব্যাহত হতে পারে।
হঠাৎ কেন আলোচনা?
প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে। এর গাণিতিক তত্ত্ব অনেক আগে আবিষ্কার হলেও, এই বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের জন্য ম্যাথম্যাটিক্যাল মডেলের অভাব ছিল।
কিন্তু গত কয়েক বছরে কম্পিউটিং পাওয়ার বৃদ্ধির পাশাপাশি, এই প্রযুক্তি সহজলভ্য হয়ে ওঠার কারণে এই খাতের নেতারা এর নেতিবাচক দিক নিয়েও সতর্ক থাকতে চাইছেন।
ঢাকায় একজন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ জাকারিয়া স্বপন বলছেন, প্রত্যেক দশ বছরে কম্পিউটিং-এর ক্ষমতা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাচ্ছে। যেহেতু এই প্রযুক্তি মানুষ সম্পর্কে অনেক বেশি তথ্য সংগ্রহ করে ফেলেছে, এবং সেসব তথ্য মানুষের চেয়েও দ্রুত গতিতে প্রসেস করতে পারছে, তার ফলে সাধারণ মানুষের জীবনের ওপরে এর প্রভাব পড়ছে।
প্রযুক্তির এই অগ্রগতি তো মানুষের জন্য সুখবর। তাহলে এ নিয়ে এতো উদ্বেগ কেন?
“একটা কারণ হচ্ছে মানুষের যেসব কাজ তার একটা বড় অংশ আগামীতে মেশিনের হাতে চলে যাবে। অনেক জায়গাতে সেটা হয়েও গেছে। ফলে একটা হচ্ছে কাজ হারানোর ভয়। আরেকটা ভয় হচ্ছে এই প্রযুক্তির অপব্যবহারের আশঙ্কা,” বলেন মি. স্বপন।
তিনি বলছেন এধরনের ভয়ের মধ্যে রয়েছে: ফেক নিউজ, ফেক ইভেন্ট, এমনকি ফেক রিলেশনশিপ।
“আরো যে বিষয়টি প্রকট হয়ে উঠতে পারে সেটা হচ্ছে বৈষম্য। আমরা একসময় বলতাম ডিজিটাল ডিভাইড। যার কাছে প্রযুক্তি আছে এবং যার কাছে প্রযুক্তি নেই তাদের মধ্যকার এই গ্যাপ নিয়ে আমরা কয়েক দশক ধরেই সোচ্চার ছিলাম। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে মানুষে মানুষে, সমাজে সমাজে এবং দেশে দেশে এই বিভাজন এখন আরো বেড়ে যাবে,” বলেন তিনি।
এআই বিপ্লব
সাম্প্রতিককালে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের জগতে বড় ধরনের বিপ্লব ঘটে গেছে। অনেক কাজই এখন একটি যন্ত্র মানুষে চেয়েও দ্রুত এবং নিখুঁতভাবে করে দিতে পারে।
হঠাৎ করেই এই অগ্রগতির কারণ কী? কিভাবে এটি সম্ভব হলো?
যুক্তরাষ্ট্রে গুগলের একজন টেকনিক্যাল ম্যানেজার তানজিম আহসান বলছেন সুপার কম্পিউটিং পাওয়ারের কারণে এই অসম্ভব সম্ভব হয়েছে।
এআই জগতে গডফাদারদের একজন জেফ্রি হিন্টন কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে যেসব উন্নতি হচ্ছে – তার বিপদ সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছেন
“গত কয়েক বছরে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। আগে কোনো কোম্পানি যদি ইন্টেল সিপিও বানাতো ওরাই শুধু জানতো এটা কিভাবে বানাতে হয়। এটা ছিল বিশেষ একটা জ্ঞান। কিন্তু এখন এই সেমিকন্ডাক্টর একটা পণ্যে পরিণত হয়েছে। আমরা যেমন যে কোনো জায়গা থেকে একটা পেরেক কিনতে পারি, এখন সেমিকন্ডাক্টরের বিষয়টাও সেরকম হয়ে গেছে,” বলেন তিনি।
“এই শিল্পের এধরনের বিস্ফোরণের ফলে যে কেউ যে কোনো জায়গা থেকে এটা কিনে একটা প্ল্যাটফর্ম বানিয়ে সেটার ওপর যেকোনো ধরনের মডেলিং ও টেস্টিং করতে পারে। অ্যামাজন, গুগল এবং মাইক্রোসফট এই তিনটি বড় কোম্পানি ক্লাউড সার্ভিস তৈরি করার কারণে বিশ্বের যেকোনো জায়গা থেকে একটা মুদির দোকানও সেটা ব্যবহার করতে পারে যা তার জন্য আগে অনেক ব্যয়বহুল ছিল। কিন্তু এখন এই সুপার কম্পিউটিং পাওয়ারের কারণে যে কেউই এসব কাজ করতে পারছে। এর ফলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গণতন্ত্রায়নও হয়েছে,” বলেন মি. আহসান।
ইংরেজি বর্ণমালার অক্ষরে ABC দিয়ে জেনে নেওয়া যাক ৩ টি এআই
এ: আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই)
গত বছরের নভেম্বরে মাইক্রোসফটের অর্থায়নে মার্কিন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান ওপেনএআই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) চালিত চ্যাটবট চ্যাটজিপিটি উন্মুক্ত করে। প্রযুক্তি–দুনিয়ায় হইচই ফেলে দেওয়া চ্যাটজিপিটি সম্পর্কে মানুষের আগ্রহও বাড়তে থাকে। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই এ বছরের প্রযুক্তিবিশ্বে সব চেয়ে উচ্চারিত একটি নাম। এ বছর প্রায় প্রতিটি শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক চ্যাটবট উন্মুক্ত করেছে। চালু হয়েছে এআইভিত্তিক নানা সুবিধাও।
বি: বার্ড
গত মার্চ মাসে বার্ড (বিএআরডি) নামের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত চ্যাটবট উন্মুক্ত করে গুগল। চ্যাটবটটি গুগলের এলএএমডিএ (ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল ফর ডায়ালগ অ্যাপ্লিকেশন) প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ইংরেজি ভাষায় করা যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দ্রুত দিতে পারে। শুধু তা-ই নয়, জি-মেইলের ইনবক্সে থাকা বিভিন্ন ই-মেইলের পাশাপাশি গুগল ডকস থেকেও প্রয়োজনীয় তথ্য খুঁজে দেয়।
সি: চ্যাটজিপিটি
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত চ্যাটজিপিটি চ্যাটবট যেকোনো বার্তার উত্তর দ্রুত ও নির্ভুলভাবে দিতে পারে। নিজ থেকে বার্তা, নিবন্ধ বা কবিতাও লিখে থাকে। নির্ভুল শব্দচয়ন ও ভাষা ব্যবহার করায় চ্যাটজিপিটির লেখা মানুষের মতোই হয়ে থাকে।
এক সময় ধারণা করা হতো- একই ধরনের যেসব কাজ বারবার করতে হয় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের পক্ষে শুধু সেসব কাজই করা সম্ভব। এই প্রযুক্তি মানুষের করে দেওয়া প্রোগ্রামের বাইরে যেতে পারবে না। কিন্তু চ্যাটজিপিটির মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে এখন অনেক কিছুই করা সম্ভব যা মানুষ ভাবতেও পারেনি।
https://bangla-bnb.saturnwp.link/%e0%a6%9a%e0%a6%be%e0%a6%81%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%89%e0%a6%aa%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6%e0%a7%87%e0%a6%b0/
চ্যাটজিপিটির সাথে রসিকতা করলে সে বুঝতে পারে। শুধু তাই নয়, ব্যবহারের সাথে সাথে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নতুন নতুন জিনিস শিখতেও পারে এবং এর মধ্য দিয়ে সে নিজেকে আরো বেশি সমৃদ্ধ করতে থাকে।