হাতিমাথা স্বর্গের সিঁড়ি, খাগড়াছড়ি । দেশের অধিকাংশ পর্যটন স্পটই প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট। তবে এর বাইরে মানুষের তৈরি করা কিছু কাজ নান্দনিকতার কারণে কাকতালীয়ভাবে পর্যটন স্পটের তকমা পেয়ে বসে। তেমনি একটি হলো খাগড়াছড়ির ‘হাতির মাথা সিঁড়ি’ (Hati Matha Siri Khagrachhari)। প্রায় ৩শ ফুট দীর্ঘ এই শোভা খাগড়াছড়ির সদর উপজেলার পেরাছড়া ইউনিয়নে অবস্থিত। পাহাড়িভাবে একে মায়ুং কপাল বা হাতিমুড়া নামেও ডাকা হয়। স্থানীদের কাছে হাতিমাথা খ্যাত এই স্থানের চাকমা নাম ‘এদো সিরে মোন’। আবার অনেকের কাছে এটি স্বর্গের সিড়ি হিসাবেও পরিচিত। স্বর্গের সিঁড়িটা মর্ত্যভূমি থেকে উঠে গেছে সোজা উপরের দিকে। পাহাড় আর বনের ফাঁকে ফাঁকে চলা সেই সিঁড়ির শেষ দেখা যায় না। উপরে যেন স্বর্গেই শেষ হয়েছে সিঁড়িটা।
বনের মাঝে এঁকে বেঁকে উঠে যাওয়া রাস্তাটা দেখতে ভয়ংকর লাগলেও আসলে তেমন নয়। একটু সাবধানে উঠলেই হবে। রাস্তাটির স্থানীয় নাম মায়ুংকপাল বা হাতিমাথা পাহাড়ের সিঁড়ি। স্বর্গে যাওয়া না হলেও এই সিঁড়ি আপনাকে নিয়ে যাবে পাহাড়ের চূড়ায় অসম্ভব সুন্দর গ্রামে। আদিবাসীদের গ্রামগুলোকে পাড়া বলে। ছোট একটি পাড়া আছে এখানে।
খাগড়াছড়ি জেলার উপজেলা সদরের পেরাছড়া ইউনিয়নের মায়ুং কপাল / হাতি মুড়া হচ্ছে একটি পাহাড়ি উঁচু পথ। স্থানীয় অনেকেই আবার একে হাতি মাথা ডাকে। চাকমা ভাষায় যার নাম – এদো সিরে মোন। অনেকে একে স্বর্গের সিড়ি ও বলে থাকেন। খাড়া পাহাড় ডিঙ্গিয়ে দুর্গম এই পথে যাতায়াত করে ১৫টি গ্রামের মানুষ। সদর উপজেলা ও মাটিরাঙ্গা উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম ভাঙ্গামুড়া, বাদলছড়া, মাখণ তৈসা পাড়া,কিনাপা পাড়া,হাজা পাড়া,বগড়া পাড়া,কেশব মহাজনপাড়া, সাধুপাড়া, কাপতলাপাড়ার মানুষের জীবন যাত্রাকে একটিু সহজ করার জন্য নির্মিত হয়েছে ৩০৮ ফুট লম্বা লোহার তৈরি সিঁড়ি এতে প্রায় ৩০০ ধাপ রয়েছে।
এই পাহাড়ের আরেক নাম হাতিমুড়া। স্থানীয়দের মতে, এটির অবয়ব দেখতে অনেকটা হাতির মতো। পাহাড়ে বসবাসকারী ত্রিপুরারা এ পাহাড়ের নামকরণ করে ‘মাইয়োং কপা’। আবার চাকমারা এ পাহাড়কে ‘এদো শিরে মোন’ নামে জানে। চাকমা ও ত্রিপুরা ভাষায় এ শব্দ দুটির মানে হলো ‘হাতির মাথা পাহাড়’।
স্থানীয়দের দেয়া যত নামই থাকুক না কেন, পর্যটকরা এ পাহাড়কে ‘স্বর্গের সিঁড়ি’ নামেই চেনে। আর তাদের ধারণা, এ সিঁড়ির ওপর থেকে দেখা যায় খাগড়াছড়ির সব পাহাড়ের সবুজ ঢেউয়ের খেলা। খাগড়াছড়ি জেলার অনেকাংশই দেখা যায় এ পাহাড়ের চূড়া থেকে, যা দেখতে স্বর্গীয়। আর এ থেকেই হয়তো এর নামটা এমন হয়েছে।
কেন এ সিঁড়ি নির্মিত হয়?
সুউচ্চ এ পাহাড় পার হলেই স্থানীয় আদিবাসীদের গ্রাম, তাই এই খাড়া পথ পাড়ি দিয়েই তাদের চলাচল করতে হতো এবং গাছের গুঁড়ি নিয়েও যাতায়াত করতে হতো। এ কষ্ট লাঘব করতেই চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ২০১৫ সালে এ সিঁড়ি নির্মাণ করে দেয়। ১১০-১২০ ডিগ্রি কোণে নির্মিত এ সিঁড়িতে রয়েছে ৩০০টি ধাপ, যা প্রায় ৩০৮ ফুটের কাছাকাছি।
বর্তমানে যাতায়াতের পথ হিসেবে প্রায় ১৫টি আদিবাসী গ্রামের বাসিন্দা এ সিঁড়ি ব্যবহার করছে। আদিবাসীদের সুবিধার জন্য তৈরি হলেও বর্তমানে পর্যটকদের এক বিরাট আকর্ষণে পরিণত হয়েছে এটি। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটক আসেন এ সিঁড়ি দেখতে।
খাগড়াছড়ির পেরাছেরা গ্রামের পরই প্রবাহিত হয়েছে খরস্রোতা পাহাড়ি নদী চেঙ্গি। এ নদী পার হয়েই যেতে হবে হাতিমুড়ায়। নদীর ওপর চলাচলের জন্য কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে সাঁকো। চেঙ্গি নদীর পরেই বিস্তৃত পাহাড়ি সমতল ভূমি। কোথাও দু’পাশে পাহাড়ি চাষাবাদ করা হয়েছে, আবার কোথাও ধু ধু প্রান্তর। এসব মাঠ পেরিয়ে গেলেই দেখা মিলবে আরেকটি পাহাড়ি গ্রামের। এ গ্রামের নামও বেশ বৈচিত্র্যময় ‘বানতৈসা’।
নৃতাত্ত্বিক ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীরা মূলত এ গ্রামের বাসিন্দা। বানতৈসা গ্রামের পর স্বর্গের সিঁড়ি পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত আর কোনো লোকালয়ের দেখা মিলবে না, তবে পাহাড়ের আনাচে-কানাচে ছোট ছোট মাচাঘর দেখা যাবে। বানতৈসার পর পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে হবে স্বর্গের সিঁড়ি দেখতে। অধিকাংশ পাহাড়ের একপাশেই বিরাট বিরাট গর্ত, তাই সতর্কতা আবশ্যক।
পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়বে আদিবাসীদের জুমচাষ। এ এলাকায় অধিকাংশ লোকের পেশা কৃষিকাজ। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীতে ভিন্ন ভিন্ন রূপ নেয় এখানকার পরিবেশে। গ্রীষ্মে রুক্ষ হয়ে যায় প্রকৃতি, বর্ষায় প্রকৃতির সবটুকু সবুজ যেন এখানে জড়ো হয়, আর শীতে কুয়াশায় চাদর গায়ে দিয়ে বিশ্রাম নেয় এ পাহাড়।
কুয়ার পানি কাচের মতো স্বচ্ছ আর বরফের মতো ঠান্ডা, যা পান করতেও আরাম। পানির সংকট ছাড়াও রয়েছে পাহাড়ে পথ হারানোর ভয়। এ ভয় স্থানীয়দের জন্য নয়, বরং যারা ঘুরতে যায় তাদের জন্য। কিছু কিছু জায়গায় দেখা যায়, একেকটা পথ একেক দিকে চলে গেছে, সেসব জায়গাতেই হতে পারে বিপত্তি। তাই পর্যটকদের দলবদ্ধভাবে চলাচল করা উচিত।
হাতিমুড়া পাহাড়ের মোট উচ্চতা ১ হাজার ২০৮ ফুট, যার প্রায় ৯০০ ফুট পথ উঁচু-নিচু পাহাড়ি রাস্তা আর অবশিষ্ট ৩০৮ ফুট জুড়ে এই স্বর্গের সিঁড়ি। দেখতে যতটা সুন্দর আর সহজ মনে হয়, তত সহজ নয় ৩০০ ধাপের এই সিঁড়ি পাড়ি দেয়া। এটা কেউ ভ্রমণ না করলে বুঝতেই পারবে না কি রকম অ্যাডভেঞ্চার। অনেক রোমাঞ্চকর এবং কষ্টের ভ্রমণ।
তবে ওঠে গেলেই দেখতে পাবেন, চারদিকে সবুজের ছড়াছড়ি। সিঁড়ির একেবারে শেষপ্রান্তে উঠলেই দেখা যাবে পুরো খাগড়াছড়িকে, আর পেছনে ফিরে তাকালেই দেখতে পাবেন, বিশাল এক পাহাড় হেঁটে পেছনে ফেলে এসেছেন। সামনে তাকালেই সবুজ পাহাড় ও সাদা মেঘের ছড়াছড়ি।
যাওয়ার উপায়
মায়ুং কপাল / হাতিমুড়া যেতে হলে প্রথমে খাগড়াছড়ি সদর থেকে পানছড়ি যাওয়ার পথে জামতলীস্থ যাত্রী ছাউনির সামনে নামতে হবে। এরপর জামতলীস্থ যাত্রী ছাউনির বামদিকের রাস্তা ধরে সোজা গিয়ে চেঙ্গী নদী পার হয়ে ডান দিকে স্কুলের রাস্তার দিকে যেতে হবে। স্কুলের নাম পল্টনজয় সঃ প্রাঃ বিদ্যালয়। ওখানে গিয়ে একটি দোকান পাবেন। দোকানের সামনে দিয়ে ডানের রাস্তা ধরে যেতে হবে। দুটি বাঁশের সাঁকো পার হতে হবে। এরপর ডানদিকে ছড়ার পাশ দিয়ে যে ছোট্ট রাস্তা গেছে, সেটি দিয়ে অারেকটি বাঁশ-গাছের সাঁকো পার হয়ে এবার সোজা পথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে। এখানে বগড়া পাড়া নামে একটি পাড়া পড়বে। এরপর সামনে এগুলে বিস্তৃত ছড়া পড়বে। এরপর একটি বড় টিলা পার হতে হবে। এটি পার হলে একটি লোকালয় পাওয়া যাবে, যে এলাকার নাম কাপতলা। এরপর হাতের ডান দিকে নিচু পথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে, যেতে যেতে সামনে দুইটি রাস্তা পাওয়া যাবে এবং ডান দিকের রাস্তা ধরে এগুতে হবে। এরপর দেখা মিলবে অসাধারণ মায়ুং কপাল/হাতি মুড়া (Hatimura)। সব মিলিয়ে পৌঁছাতে সময় লাগবে ঘন্টা দেড়েক। ট্রেকিং মোটামুটি কষ্টের কারন ছোট খাটো পাহাড় পাড়ি দিতে হবে। সাথে করে অবশ্যই পানি এবং শুকনা খাবার নিয়ে যাবেন।
কোথায় থাকবেন
খাগড়াছড়িতে (Khagrachhari) পর্যটন মোটেল সহ বিভিন্ন মানের থাকার হোটেল (Hotel) আছে ।
পর্যটন মোটেলঃ এটি শহরে ঢুকতেই চেঙ্গী নদী পার হলেই পরবে। মোটেলের সব কক্ষই ২ বিছানার। ভাড়াঃ এসি ২১০০ টাকা, নন এসি ১৩০০ টাকা । এসি স্যুইট রুম ৩,১০০ টাকা। মোটেলের অভ্যন্তরে মাটিতে বাংলাদেশের মানচিত্র বানানো আছে। তবে পুরো খাগড়াছড়ি জেলায় বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে ভোল্টেজ ওঠানামা করায় এসি রুমগুলো নন-এসি হিসেবে ভাড়া দেয়া হচ্ছে। এছাড়া হোটেল ইকো ছড়ি ইন, হোটেল শৈল সুবর্ন, হোটেল জেরিন, হোটেল লবিয়ত, হোটেল শিল্পী