গত তিন দশকে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ও টেলিযোগাযোগ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। দেশে স্বাস্থ্য সূচকে উন্নতির জায়গাগুলো হলো নবজাতক ও শিশুমৃত্যুর হার কমানো, মাতৃমৃত্যু কমানো, পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের পুষ্টিমান বাড়ানো, টিকা প্রদান কার্যক্রম জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া। আর এসব সম্ভব হয়েছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলজুড়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ব্যবস্থার একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার ফলে। এ নেটওয়ার্কের মধ্যে রয়েছে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক। অন্যদিকে টেলিযোগাযোগ খাতে অগ্রগতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক হলো মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট পরিষেবা দেশের প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়া।
দেশের প্রান্তিক অঞ্চল ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীসহ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এখনো বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। সেগুলো হলো স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি ও প্রদানে বৈষম্য দূর করা; সবার জন্য গুণগত মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করা; স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল গড়ে তোলা এবং জনগোষ্ঠীর মাঝে স্বাস্থ্য স্বাক্ষরতা গড়ে তোলা। দেশে চিকিৎসক ও চিকিৎসা সেবাকর্মীদের সংখ্যা আজও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।
প্রযুক্তির এ উৎকর্ষ ও প্রসার জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করেছে। বিভিন্ন ধরনের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এখন স্বাস্থ্যসেবা দেশের যেকোনো সময়, যেকোনো স্থান থেকে যেকোনো স্থানে পৌঁছে দেয়া সম্ভব। কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন ও অন্যান্য যোগাযোগ প্রযুক্তির সাহায্যে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া ও নেয়ার ব্যবস্থাকেই বলা হয় টেলিমেডিসিন। স্বাস্থ্যসেবার উদ্দেশ্য, ধরন, প্রক্রিয়া ও প্রযুক্তি ব্যবহারের ভিত্তিতে একে কখনো কখনো টেলিহেলথ, ই-হেলথ, এম-হেলথ বা মোবাইল হেলথ ও টেলিকেয়ার নামেও অভিহিত করা হয়।
সামগ্রিকভাবে টেলিমেডিসিনের লক্ষ্য হলো ব্যক্তি ও সমাজের স্বাস্থ্যের মান উন্নয়ন করা। মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ ব্যবহার করে ভিডিও কলের মাধ্যমে রোগীদের সঙ্গে চিকিৎসকরা কথা বলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পরামর্শ দেয়াই টেলিমেডিসিন সেবা। এখন ঢাকা ছাড়াও দেশের জেলা, উপজেলা পর্যায়েও টেলিমেডিসিন সেবা দেয়া শুরু করেছে হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো। বাংলাদেশে টেলিমেডিসিন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার ও সহজলভ্যতা; জনগণের শিক্ষার হার বৃদ্ধি ও জীবনমানের উন্নতি; সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ। সরকারি উদ্যোগ বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও অঙ্গ প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর; সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলো, জেলা সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিউনিটি ক্লিনিক।
বর্তমানে দেশের অধিকাংশ হাসপাতাল কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার মেডিকেল রেকর্ড নিয়মতান্ত্রিকভাবে ডাটাবেজে রাখতে বিভিন্ন সফটওয়্যার ব্যবহার করে। সংরক্ষণ করে রোগীর চিকিৎসাসংক্রান্ত সব তথ্য-উপাত্ত। চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট কিংবা ল্যাব টেস্ট এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি সহজ। ল্যাব টেস্টকে সহজ করতে বর্তমানে দেশের কয়েকটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ঘরে বসেই নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা চালু করেছে। এখন প্যাথলজি পরীক্ষার জন্য মানুষের ভিড় ঠেলে হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে হয় না। নমুনা সংগ্রহের পর ই-মেইল, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অ্যাপ এবং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে খুব সহজেই পাওয়া যায় টেস্ট রিপোর্ট। একটি টেলিমেডিসিন অ্যাপ কিংবা ওয়েবসাইটের সাহায্যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে স্বাস্থ্য পরামর্শ নেয়া যায়। এতে মূল্যবান সময় ও অর্থ সাশ্রয় হয়। স্বাস্থ্যসেবা অ্যাপ আজকাল গ্রাহকদের ওষুধ ডেলিভারির সুবিধাও দিচ্ছে। ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবায় ব্যবহৃত নানা আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে ব্যাপক মাত্রায়। ফলে চিকিৎসার কার্যকারিতা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। সহজ হয়েছে সেবা গ্রহণ প্রক্রিয়াও। ফলে বাড়ছে ঘরে বসে স্বাস্থ্যসেবা নেয়ার আগ্রহ। কাজেই এটা জোর দিয়েই বলা যায় যে রোগ প্রতিরোধ ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারলে কমানো যাবে মানুষের চিকিৎসা ব্যয়। এক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগগুলো বেশ লক্ষণীয়। যেমন ডিজিটাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি। এটি চালু হলে সেবাপ্রার্থীরা ঘরে বসেই অনলাইনে নির্দিষ্ট ফি দিয়ে আউটডোরের টিকিট সংগ্রহ করতে পারবেন। চিকিৎসকরা ডিজিটাল ডিভাইসে ব্যবস্থাপত্র লিখবেন। হাসপাতাল থেকে ওষুধ সংগ্রহের জন্যও আলাদা করে ব্যবস্থাপত্রের প্রয়োজন হবে না। রোগীর পুরো তথ্য ও রোগবৃত্তান্ত তথ্যভাণ্ডারে থাকবে, যা ভবিষ্যতে চিকিৎসার জন্য সহায়ক হবে।
দেশে ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাত, বিভিন্ন এনজিও ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানও কাজ করছে। সরকারি খাতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় নীতি প্রণয়ন, পরিকল্পনা এবং সামগ্রিক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। মন্ত্রণালয়ের অধীনে চারটি অধিদপ্তর যথাক্রমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট, নার্সিং সেবা পরিদপ্তর ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে থাকে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি, জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টিনীতি এবং জাতীয় জনসংখ্যা নীতি বাস্তবায়ন করছে।
বর্তমানে ৬৫টি কেন্দ্রের মাধ্যমে টেলিমেডিসিন স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করছে সরকার। বাংলাদেশে টেলিমেডিসিন কার্যক্রমের যাত্রা আসলে দাতব্য সংস্থা ও এনজিওর হাত ধরেই। জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবার অমিত সম্ভাবনার কথা বলা হলেও চ্যালেঞ্জও প্রচুর। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের ডিজিটাল স্বাক্ষরতা ও স্বাস্থ্য সাক্ষরতার অভাব দেশে স্বাস্থ্যবৈষম্যকে বাড়িয়ে দিতে পারে। এছাড়া টেলিমেডিসিন ব্যবস্থায় চিকিৎসকদের প্রশিক্ষিত করে তোলাও জরুরি।
https://bangla-bnb.saturnwp.link/%e0%a6%95%e0%a7%83%e0%a6%b7%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%87-%e0%a6%86%e0%a6%a7%e0%a7%81%e0%a6%a8%e0%a6%bf%e0%a6%95-%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%af%e0%a7%81%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%b0/
কেননা চিকিৎসা দেয়া ও আরোগ্য ব্যবস্থায় চিকিৎসকের যোগাযোগ দক্ষতাও খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ও ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ অর্জনের জন্য গর্ভাবস্থায় সমস্যা চিহ্নিতকরণ, সার্বক্ষণিক গর্ভাবস্থা পর্যবেক্ষণ, শেয়ারড হেলথ রেকর্ড, হেলথ আইডি, রেফারেল সিস্টেম, অনলাইন পেশেন্ট অ্যাপয়েন্টমেন্ট সিস্টেম, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা মডেল, অনলাইন রেফারেল সিস্টেম, অনলাইন পেশেন্ট অ্যাপয়েন্টমেন্ট সিস্টেম এখন সময়ের দাবি। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর), অগমেন্টেড রিয়েলিটি (এআর), কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), কিংবা মেশিন লার্নিংয়ের (এমএল) মতো প্রযুক্তির ব্যবহার করে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ব্যবস্থার উদ্ভাবন ও প্রসারকে উৎসাহিত করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি অংশীজন, উদ্ভাবক ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিজ্ঞানী ও গবেষকদের সঙ্গে নিয়ে ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে কাজ করতে হবে।