পারেননি পেলে, পারেননি জিদান, কাকা, রোনালদো নাজারিও কিংবা ডিয়েগো ম্যারাডোনাও। ফুটবলের ১২০ গজের মাঠে কতশত রেকর্ডই প্রতিদিন জন্ম নেয়। কিন্তু ফুটবলের ১২০ গজের মাঠে এমন কিছু রেকর্ড আছে, যেখানে কিংবদন্তিদের নামটা হয়ত কখনোই জায়গা করতে পারেনি। ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা দলগুলোও যে রেকর্ড গড়তে ব্যর্থ হয়েছে, লিওনেল স্কালোনির তারুণ্যনির্ভর আর্জেন্টিনা এবার সেই রেকর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে।
টানা তিন আন্তর্জাতিক শিরোপা জেতার রেকর্ড নেই দক্ষিণ আমেরিকার কোনো দেশের। দুইবার মহাদেশীয় শিরোপা এবং এক বিশ্বকাপ জেতার কীর্তি গড়তে পারেনি লাতিনের কালজয়ী সব দল। এমনকি ইউরোপে প্রজন্ম বা সর্বকালের সেরা দলগুলোও পারেনি নিজেদের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে।একমাত্র দেশ হিসেবে এই কৃতিত্ব আছে স্পেনের। ২০০৮ সালের ইউরো, ২০১০ বিশ্বকাপ এবং ২০১২ সালের ইউরো টানা জয় করেছিল দেশটি।
এবার আর্জেন্টিনার সামনে আছে সেই সুযোগ। ২০২১ সালে কোপা আমেরিকা আর ২০২২ সালে বিশ্বকাপ নিজেদের ঝুলিতে পুরেছে লিওনেল মেসিরা। এবার বাকি ২০২৪ সালের কোপা আমেরিকা। স্বপ্নের এই ট্রেবলের চক্রপূরণ করতে আর্জেন্টিনার দরকার আর এক জয়। ১৫ জুলাইয়ের ফাইনালে জিতলেই ফুটবলের বিরল এই রেকর্ড স্পর্শ করবে আর্জেন্টিনা।
২০০৮ সাল থেকেই শুরু হয় ফুটবলে স্প্যানিশ রাজত্ব। সেবার স্পেনের কোচ ছিলেন লুইস আরাগোনেস। অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদের কিংবদন্তি কোচ ২০০৬ বিশ্বকাপে ভালো কিছু করে দেখাতে পারেননি। ২০০৮ সালে এসে দলকে খেলালেন একটু ভিন্ন ধাঁচে। আরাগোনেস খেয়াল করলেন, তার দলের জাভি, ইনিয়েস্তা, মার্কোস সেনা কিংবা জাবি আলোন্সরা বল পায়ে রেখে খেলতে পছন্দ করে।
সেবার খেলোয়াড়দের পছন্দের ট্যাকটিক্সে খেলা গিয়ে আরাগোনেসের ধরে জন্ম নেয় টিকিটাকা ফুটবল। যে ফুটবল আগে কখনোই দেখেনি ফুটবল দুনিয়া। স্পেন দল খেলল চোখধাঁধানো ফুটবল। ২০০৮ সালে এসে ৪৪ বছর পর বড় শিরোপা জয় করল স্পেন।
এরপর লা রোহাদের কোচ হয়ে এলেন রিয়াল মাদ্রিদের কিংবদন্তি ভিসেন্তে দেল বস্ক। রিয়াল মাদ্রিদের এই কিংবদন্তি কোচের স্পেন ঠিক কেমন ফুটবল উপহার দিয়েছিল তা কারোরই অজানা নয়। ২০১০ সালের বিশ্বকাপের সেই দলকে রাখা হয় সর্বকালের সেরাদের কাতারে। ইতিহাসে সবচেয়ে কম গোল দিয়ে বিশ্বকাপ জিতেছিল তারা। কিন্তু উপহার দিয়েছিল ইতিহাসে অমর হয়ে থাকার মতো ফুটবল।
দেল বস্ক কেবল বিশ্বকাপ জিতেই থামলেন না। ২০১২ সালের ইউরোটাও জয় করলেন এই অভিজ্ঞ কোচ। প্রথমবার বিশ্বকে দেখালেন কোনো স্ট্রাইকার ছাড়া ৬ জন মিডফিল্ডার নিয়েও শিরোপা জেতা যায়। ২০১২ ইউরো ফাইনালে ইতালি বিধ্বস্ত হয় ৪-০ গোলে।
স্পেনের সেই সর্বজয়ী দলটা ভেঙে যায় ২০১৪ সালে। আর সেখান থেকেই একটু একটু করে জন্ম নিলো আর্জেন্টাইন ফুটবলের নতুন এক প্রজন্ম। ১৪ এর ফাইনালে মারাকানায় আলবিসেলেস্তেদের হার দেখে মন ভেঙেছিল একঝাক কিশোরের।
২০১৮ ফুটবলে আর্জেন্টিনার বিদায়ের পর কোচ হলেন লিওনেল স্কালোনি। গড়ে তুললেন তারুণ্যনির্ভর এক দল। যে দল মেসিকে কেন্দ্র করে খেলে না। বরং তারা খেলে মেসির জন্য। রদ্রিগো ডি পল, এমিলিয়ানো মার্তিনেজ, অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টার কিংবা হুলিয়ান আলভারেজদের নিয়ে আর্জেন্টিনা এগুতে থাকে স্বপ্নের দিকে।
তিন সিনিয়র ফুটবলার লিওনেল মেসি, আনহেল ডি মারিয়া আর নিকোলাস ওতামেন্ডির পাশে একঝাক তরুণ। আর্জেন্টিনার উত্থানের গল্পটা এভাবেই। ২০২১ সালে মারাকানায় ব্রাজিলকে হারানো কিংবা ২০২২ সালের বিশ্বকাপে অদম্য ফুটবল যাত্রা… আর্জেন্টিনা শুধু ট্রফিখরার শেষ করেনি। যাত্রা শুরু করেছিল ইতিহাসের পথে।
আরাগোনেস আর দেল বস্ক দুজন মিলে করেছিলেন ট্রফির চক্রপূরণ। সেদিক থেকে লিওনেল স্কালোনির এই দলের মাহাত্ম্য আলাদা। কোচ হিসেবে স্কালোনি একাই শুরু করেছিলেন সবকিছু। এবার সেটায় তুলির শেষ আঁচড় দেয়ার পালা। ১৫ জুলাইয়ের ফাইনালে তাই আর্জেন্টিনার জয়টাই ভীষণভাবে দেখতে চাইবে ফুটবল দুনিয়া।