গ্রীষ্মের শেষে প্রথম বৃষ্টি হলেই আমরা গাছ রোপণের কথা চিন্তা করি। ভাবি, বাড়ির আশপাশের ফাঁকা জায়গাটা এবার গাছে গাছে ভরিয়ে দেবো। বাদ যাবে না ঘরের বারান্দা কিংবা ছাদও। অনেকের চিন্তাটা মাথার ভেতরেই ঘুরপাক খেতে থাকলেও অনেকে বাস্তবায়ন করতে মাঠেও নেমে পড়ি। প্রিয় গাছের চারা বা কলম খুঁজতে ছুটে যাই সরকারি বা বেসরকারি নার্সারিতে। কাংখিত গাছের চারা বা কলম পেয়েও যাই। তাৎক্ষণিকভাবে রোপণের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় লাগিয়েও ফেলি। লাগিয়েই ভাবি, যাক কিছু দিনের মধ্যেই জায়গাটা সবুজে সবুজে ভরে যাবে। কিন্তু না, ভাবনার সাথে বাস্তবতাটা ঠিক মেলে না। ক’দিন পরেই দেখা যায় চারা বা কলম সঠিকভাবে বাড়ছে না।
ফলের বাগান করার আগে ও পরে যা করবেন
ফলের বাগান করার ইচ্ছে অনেকেরই থাকে। ফলের বাগান করার আগে কিছু প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হলে ভবিষ্যতে লাভের মুখ দেখা সহজ হবে। শুধু তাই নয়, দেশে ফলের বাগান বাড়লে বিদেশ থেকে ফল আমদানিও কমবে। ফলের বাগান করে আপনিও বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা করে নিতে পারবেন।
বাগানের সার্বিক সুরক্ষার খাতিরে ভূমি প্রস্তুতকরণের সঙ্গে সঙ্গে বাগান এলাকার চারদিকে স্থায়ীভাবে বেড়া, এমনকি পাকা দেয়াল নির্মাণের কাজটি সারতে পারেন। প্রতি চারার চারদিক ঘিরে বাঁশের বেড়া দিলে তাত্ক্ষণিক গরু-ছাগলসহ অন্যান্য পশু থেকে গাছ রক্ষা করা যেতে পারে। কিন্তু মিশ্র ফল-বাগান হচ্ছে একটি দীর্ঘকালীন প্রকল্প।
বিভিন্ন উপদ্রব থেকে বাগানকে রক্ষার জন্য চারদিকে বেড়া দিতে হয়। স্থায়ী বেড়া ইট-নির্মিত, অস্থায়ী বেড়া বাঁশের দরজা দিয়ে তৈরি এবং হেজ বা জীবন্ত বেড়া গাছ দিয়ে তৈরি করতে হবে। জীবন্ত বেড়া দীর্ঘস্থায়ী হয়। স্বল্প-ব্যয়ে এটি সম্পন্ন করা যাবে। এ জন্য বাইরের দিকে সীমানা-বরাবর কাঁটা তারের বেড়া দেয়া যেতে পারে। আবার সরাসরিও হেজের গাছ করা যেতে পারে। কাঁটা তার টানার জন্য কংক্রিট-নির্মিত খাম কিংবা জিওলাজাতীয় খুঁটি স্থাপন করা যায়। হেজের গাছ ঝোপালো, ছাঁটাইয়ের জন্য উপযুক্ত, চিরসবুজ, ছাগলের আকর্ষণমুক্ত, কমযত্নে জন্মানোর উপযোগী এবং পোকা-মাকড় ও রোগবালাই প্রতিরোধ্য হলে ভালো হয়। দুরন্ত, কাঁটা-মেহেদী, শ্যাওড়া, করঞ্জা ও কামিনী উঁচু হেজ এবং জাস্টিসিয়া, ল্যান্টানা, অ্যাকালিফা, রঙ্গন, পাতাবাহার ও কোচিয়া অনুচ্চ হেজ তৈরির উপযোগী।
হেজের জন্য তিন সারি করে বীজ বপন করতে কিংবা শাখাকলম লাগাতে হয়। গাছগুলো প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার উচ্চতাসম্পন্ন হওয়ার পর প্রথমবার ভুতল থেকে ১৫ সেন্টিমিটারের উপরের ডগাগুলো কেটে দিতে হবে। কিছু দিন পরপর প্রয়োজনমত ছাঁটাই করে গোড়ার দিকেই গাছগুলোকে ঝোপালো ও দৃঢ় করে নিতে হবে। হেজ উত্পাদন ও সংরক্ষণের জন্য নিয়মিত সার প্রয়োগ করা এবং দরকার মতো পানি-সেচ প্রদান আবশ্যকীয়। সেচের পানির উত্স অগভীর নলকূপ, টিউবওয়েল, কূপ, পুকুর ইত্যাদি। পাম্প, রবার নল, ঝারি ইত্যাদি সেচ কাজে ব্যবহৃত হয়। নার্সারি বা উদ্যানে উত্তম পানি-নিকাশ ব্যবস্থা থাকতে হবে। জমি উঁচু হওয়া ও একদিকে ঢালু করে দেয়া এবং প্রয়োজনমত সঠিক স্থানগুলোয় বা রাস্তার পাশ দিয়ে নিকাশ-নালা খনন করে নেয়া ভালোভাবে পানি-নিকাশের পূর্ব শর্ত।
প্রতিটি চারাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রাথমিকভাবে সকাল-বিকাল গাছের গোড়ায় অল্প-বিস্তর পানি-সেচন করলেই চলবে। কিন্তু মিশ্র ফল-বাগানের বিষয়টা সাময়িক নয়, সম্পূর্ণই দীর্ঘকালীন। যারা জোড়াতালি করে কোন ধরনের কতগুলো গাছকে দাঁড় করিয়ে দিলেই চলবে এবং গাছগুলো একটু বড় হলেই পানির ব্যবস্থা ও অন্যান্য যত্ন নিজেরাই করে নেবে বলে চিন্তা করবেন, তাদের জন্য ফল-বাগান করা যুক্তিযুক্ত নয়। বৃক্ষজাতীয় ফল-বাগান অবশ্যই দালান-কোঠার মতোই একটি দীর্ঘকালীন বিষয় বলতে গেলে ১০০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা। যদি দালান-কোঠা নির্মাণ কাজে পানির ব্যবস্থার কথা ভাবতে হয় এবং প্রয়োজন বুঝে ব্যবস্থা নিতে হয়, তবে ফল-বাগানের বেলায়ও এটি হবে প্রযোজ্য।
সেক্ষেত্রে চারা ঠিকমত বসে যাওয়ার আগেই শুষ্ক জলবায়ু এসে পড়ার কারণে শুষ্ক মৌসুমে পানি-সেচের ভালো ব্যবস্থা থাকা চাই। বর্ষার আগেভাগে চারা টিকে গেলে তথা সেট হয়ে গেলে, সেটি বাগানের মালিককে অনেকটাই চিন্তামুক্ত অবস্থায় রাখতে পারে।
চারা রোপণের সর্বাপেক্ষা উত্তম সময় গ্রীষ্মকালের প্রায় সবটা আর বর্ষাকালের প্রথম দিকটা। অর্থাত্ বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাস। শ্রাবণ-ভাদ্র মাস তথা ভরাবর্ষা পরিহার করা যুক্তিযুক্ত। ভরা বর্ষায় চারা পচে যাওয়া ও মরে যাওয়ার সম্ভাবনা অধিক হয়। আশ্বিন মাসে চারা রোপণ করা চলে।
চারা রোপণের আগের কাজটি হচ্ছে গর্ত তৈরি করা। অধিকাংশ বৃক্ষ-শ্রেণীর ফলগাছের বেলায় দুই ফুট ব্যাস ও গভীরতা বিশিষ্ট গর্ত খনন করা যেতে পারে। বলতে পারেন আম, কাঁঠাল, লিচু, লেবু ইত্যাদি গাছগুলোর বড় আকারের কথা। ওই আকার হচ্ছে পরিণত-বয়স্ক গাছের। কিন্তু চারা অবস্থায় গাছগুলোর আকার যেমন প্রায় একরূপ হয়ে থাকে, তাদের রোপণও হতে পারে প্রায় একই আকারের গর্তে। প্রারম্ভিক সারের প্রকার ও পরিমাণও হতে পারে অনেকটা একইরূপ। গর্তের মাটির সঙ্গে ১০ কেজি গোবর সার, ২৫০ গ্রাম টিএসপি এবং ১০০ গ্রাম এমওপি সার মিশিয়ে দিতে হবে।
এক্ষেত্রে নিম্নরূপ পদ্ধতি ব্যবহার করা ভালো। গর্তের একার্ধ, তথা উপরের দিকের মাটি গর্তের একপাশে আর অপরার্ধ বা নিচের দিকের মাটি অপর পাশে রাখতে হবে। এ অবস্থায় ১০/১৫ দিন (নিদেনপক্ষে এক সপ্তাহকাল) খোলা অবস্থায় রেখে গর্তে ও তোলা মাটিতে রোদ-বাতাস লাগানো মন্দ নয়। তত্পর উপরের মাটির সঙ্গে সার মিশিয়ে সার-মিশ্রিত মাটি গর্তের নিচের অংশে ঢেলে দিয়ে, অবশিষ্ট তথা নিচের দিকের মাটি উপরাংশে দিয়ে গর্ত পূরণ করে দিতে হবে।
বৃষ্টি না হলে চারা রোপণের পূর্বদিন গর্তে কিছু পানি-সেচ দেয়া যেতে পারে। রোপণের জন্য বিকালই প্রকৃষ্ট সময়। চারার শেকড় যতখানি বিস্তৃত ও গভীর, সে পরিমাণ গর্তের মাটি উঠিয়ে নিয়ে গর্তে চারার নিম্নাংশ প্রবেশ করিয়ে দিতে হবে। তার পর মূলগুলোকে গর্তের মধ্যে বেশ ভালোভাবে ছড়িয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে মাটি চাপা দিতে হয়। লক্ষ্য রাখতে হবে, যেন চারাটির গোড়া পূর্ববর্তী মাটিতে যে স্থান পর্যন্ত অভ্যন্তরে ছিল এখানেও তাতে ততখানি পর্যন্ত মাটি চাপা দেয়া পড়ে। রোপণের পরে গোড়ার মাটি একটু চাপিয়ে দেয়া উত্তম। চারা রোপণের অব্যবহিত পরে এবং প্রথম কিছু দিনের জন্য প্রতিদিন ঝারি দ্বারা চারার গোড়ায় পানি সেচন করা উচিত। তা ছাড়া চারার উপরে ছায়াদানের ব্যবস্থা করা এবং গোড়ার মাটি শুষ্ক ঘাস, খড় ইত্যাদি দ্বারা ঢেকে দেয়া মন্দ নয়। রোপণের ছয় মাস পর কিছু ইউরিয়া সার ‘টপড্রেসিং’ রূপে ব্যবহার করা যেতে পারে।