রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনে রম্য উপাখ্যানের কাহিনি অফুরন্ত। কারণ, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন খুবই হাস্যরস-প্রিয়; তবে তাঁর হাস্যরস ছিল মার্জিত, সূক্ষ্ম ও সুরুচিসম্পন্ন। তাঁর পুত্রবধূ প্রতিমা ঠাকুর একদা বলেছিলেন, ‘বাবা মশায় সকলের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা করতে খুব ভালোবাসতেন। মেয়ে, বউ, পরিবারবর্গের সকলের সঙ্গে, এমনকি নীলমণি ভৃত্যের সঙ্গে হাস্য-পরিহাসে তাঁর ছিল সহজ আনন্দ।’ আইসিটি ওয়ার্ড নিউজ এর আজকের আয়োজন থাকছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে কিছু মজার তথ্য।
ঘটনা- ১
কবিগুরু একবার কিছু বন্ধু বান্ধব নিয়ে বাংলা মুলুকের বাইরে পাত্রী দেখতে গেলেন। পাত্রী খুব ধনী, সাত লাখ টাকার উত্তরাধিকারী। সে যুগে সাত লাখ টাকা যৌতুক, ভাবা যায়! তিনি যে ঘরে বসে আছেন, সে ঘরে দুজন অল্প বয়সী মেয়ে এসে বসল। এক জন নেহায়েত চুপচাপ, সাধাসিধে, জড়ভরতের মতো এক কোণায় বসে রইল। অন্য মেয়েটি যেমন সুন্দরী, তেমনি চটপটে, স্মার্ট। একটুও জড়তা নেই, সুন্দর ইংরেজি উচ্চারণ। পিয়ানো বাজাল দারুণ। সংগীত নিয়ে জ্ঞানগর্ভ টুকটাক আলোচনাও করল। রবীন্দ্রনাথের খুব পছন্দ হল মেয়েটিকে। এমন সময় বাড়ির কর্তা ঘরে ঢুকে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর মেয়ে দুটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সুন্দরী মেয়েটিকে দেখিয়ে বললেন, ‘হিয়ার ইজ মাই ওয়াইফ। ‘ আর জড়ভরতকে দেখিয়ে বললেন, ‘হিয়ার ইজ মাই ডটার।’ পাত্রী দেখার দল বিস্ময়ে হতবাক!
শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কথাশিল্পী প্রমথনাথ বিশী। তো, একবার প্রমথনাথ বিশী কবিগুরুর সঙ্গে শান্তিনিকেতনের আশ্রমের একটি ইঁদারার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ওখানে একটি গাবগাছ লাগানো ছিল। কবিগুরু হঠাৎ তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, ‘জানিস, একসময়ে এই গাছের চারাটিকে আমি খুব যত্নসহকারে লাগিয়েছিলাম? আমার ধারণা ছিল, এটা অশোকগাছ; কিন্তু যখন গাছটি বড় হলো দেখি ওটা অশোক নয়, গাবগাছ।’
অতঃপর তিনি প্রমথনাথের দিকে সরাসরি তাকিয়ে স্মিতহাস্যে যোগ করলেন, ‘তোকেও অশোকগাছ বলে লাগিয়েছি, বোধকরি তুইও গাবগাছ হবি।’
ঘটনা- ২
একবার রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজি একসঙ্গে বসে সকালের নাশতা করছিলেন। গান্ধীজি লুচি পছন্দ করতেন না, তাই তাঁকে ওটসের পরিজ খেতে দেওয়া হয়েছিল; আর কবিগুরু খাচ্ছিলেন গরম গরম লুচি।
গান্ধীজি তাই দেখে বলে উঠলেন, ‘গুরুদেব, তুমি জানো না যে তুমি বিষ খাচ্ছ।’ উত্তরে কবিগুরু বললেন, ‘বিষই হবে; তবে এর অ্যাকশন খুব ধীরে। কারণ, আমি বিগত ষাট বছর যাবৎ এই বিষ খাচ্ছি।’
ঘটনা- ৩
রবীন্দ্রনাথের একটা অভ্যাস ছিল, যখনই তিনি কোনো নাটক বা উপন্যাস লিখতেন, তা প্রথমে শান্তিনিকেতনে গুণীজন সমাবেশে পড়ে শোনাতেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রায়ই এমন পাঠের আসরে যোগদান করতেন। একবার বাইরে জুতা রেখে আসায় সেটা চুরি গেল। অতঃপর তিনি জুতা জোড়া কাগজে মুড়ে বগলদাবা করে আসরে আসতে শুরু করলেন।
রবীন্দ্রনাথ টের পেয়ে একদিন তাঁকে এভাবে দেখে বলে উঠলেন, ‘শরৎ, তোমার বগলে ওটা কি পাদুকা-পুরাণ?’
ঘটনা- ৪
একবার এক দোলপূর্ণিমার দিনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সাক্ষাৎ ঘটে। পরস্পর নমস্কার বিনিময়ের পর হঠাৎ দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর জামার পকেট থেকে আবির বের করে রবীন্দ্রনাথকে বেশ রঞ্জিত করে দিলেন।
আবিরে রঞ্জিত রবীন্দ্রনাথ রাগ না করে বরং সহাস্যে বলে উঠলেন, ‘এত দিন জানতাম দ্বিজেন বাবু হাসির গান ও নাটক লিখে সকলের মনোরঞ্জন করে থাকেন। আজ দেখছি শুধু মনোরঞ্জন নয়, দেহরঞ্জনেও তিনি একজন ওস্তাদ।’
ঘটনা- ৫
মরিস সাহেব ছিলেন শান্তিনিকেতনে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার অধ্যাপক। একা থাকলে তিনি প্রায়ই গুনগুন করে গান গাইতেন। একদিন তিনি তৎকালীন ছাত্র প্রমথনাথ বিশীকে বললেন, ‘গুরুদেব চিনির ওপর একটি গান লিখেছেন, গানটি বড়ই মিষ্টি।’ অতঃপর তিনি গানটি গাইতে লাগলেন, ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী, তুমি থাকো সিন্ধুপারে…।’
‘তা চিনির গান তো মিষ্টি হবেই। কিন্তু এই ব্যাখ্যা আপনি কোথায় পেলেন?’ প্রমথনাথ বিস্মিত হয়ে তাঁকে প্রশ্ন করলেন। উত্তরে মরিস সাহেব জানালেন, ‘কেন, স্বয়ং গুরুদেবই আমাকে বলে দিয়েছেন।’
ঘটনা- ৬
কবিগুরুর ৫০ বছর বয়সে পদার্পণ উপলক্ষে শান্তিনিকেতনের একটি কক্ষে সভা বসেছিল, যেখানে তিনি স্বকণ্ঠে গান করছিলেন। তো, তিনি গাইলেন, ‘এখনো তারে চোখে দেখিনি, শুধু কাশি শুনেছি।’ কবিগুরু এটি গেয়েছিলেন আচার্য যতীন্দ্রমোহন বাগচি ঐ কক্ষে প্রবেশের আগ মুহূর্তে, তাই বাগচি মহাশয় কক্ষে প্রবেশ করে বিস্মিত নয়নে সকলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
‘সিঁড়িতে তোমার কাশির শব্দ শুনেই গুরুদেব তোমাকে চিনেছেন’, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তখন বাগচি মহাশয়কে বুঝিয়ে দিলেন, ‘তাই তো তাঁর গানের কলিতে বাঁশির স্থলে কাশি বসিয়ে তাঁর গানটি গেয়েছেন।’’
ঘটনা- ৭
সাহিত্যিক ‘বনফুল’ তথা শ্রী বলাইচাঁদের এক ছোট ভাই বিশ্বভারতীতে অধ্যয়নের জন্য শান্তিনিকেতনে পৌঁছেই কার কাছ থেকে যেন জানলেন, রবীন্দ্রনাথ কানে একটু কম শোনেন। অতএব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি যখন বললেন, ‘কী হে, তুমি কি বলাইয়ের ভাই কানাই নাকি?’, তখন বলাইবাবুর ভাই চেঁচিয়ে জবাব দিলেন, ‘আজ্ঞে না, আমি অরবিন্দ।’ রবীন্দ্রনাথ তখন হেসে উঠে বললেন, ‘না কানাই নয়, এ যে দেখছি একেবারে সানাই!’
ঘটনা- ৮
একবার কালিদাস নাগ ও তাঁর স্ত্রী জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথ মৃদুহাস্যে নাগ-দম্পতিকে প্রশ্ন করলেন, ‘শিশু নাগদের কোথায় রেখে এলে?’ আরেকবার রবীন্দ্রনাথ তাঁর চাকর বনমালীকে তাড়াতাড়ি চা করে আনতে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে কপট বিরক্তির ভাব দেখিয়ে বললেন, ‘চা-কর বটে, কিন্তু সু-কর নয়।’
আরও একবার কবিগুরুর দুই নাতনি এসেছেন শান্তিনিকেতনে, কলকাতা থেকে। একদিন সেই নাতনি দুজন কবিগুরুর পা টিপছিলেন; অমনি তিনি বলে উঠলেন, ‘পাণিপীড়ন, না পা-নিপীড়ন?’ প্রথমটায় তারা কিছুই বুঝতে না পারলেও পরে কথাটার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পেরে খুবই মজা পেয়েছিল।
ঘটনা- ৯
একদিন সকালবেলায় রবীন্দ্রনাথ জলখাবার খেতে বসেছেন। প্রমথনাথ এসে তার পাশে বসলেন। উদ্দেশ্য, গুরুদেবের খাবারে ভাগ বসানো। ফল, লুচি, মিষ্টি সবকিছুরই ভাগ পেলেন তিনি। কিন্তু তার নজর একগ্লাস সোনালি রংয়ের শরবতের দিকে যেটা তাকে দেওয়া হয়নি। গুরুদেব তার ভাব লক্ষ করে বললেন, ‘কী হে এই শরবত চলবে নাকি?’ প্রমথ তাতে খুব রাজি। অমনি গুরুদেব বড় এক গ্লাসে সেই সরবত প্রমথকে দেওয়ার আদেশ দিলেন। বড় গ্লাস ভর্তি হয়ে সেই সোনালি শরবত এল। প্রমথনাথ এক চুমুক খেয়েই বুঝলেন, সেটা চিরতার শরবত!
ঘটনা- ১০
শান্তিনিকেতনের ছেলেদের সঙ্গে অন্য প্রতিষ্ঠানের ছেলেরা ফুটবল খেলছে। শান্তিনিকেতনের ছেলেরা আট-শূন্য গোলে জিতেছে। সবাই দারুণ খুশি। শুধু রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করলেন ‘জিতেছে ভালো, তা বলে আট গোল দিতে হবে? ভদ্রতা বলেও তো একটা কথা আছে।’
(বিশেষ eআরকি: গত বিশ্বকাপে ব্রাজিল এবং জার্মানির মধ্যকার সেমিফাইনালটি কবিগুরুর খুব পছন্দ হতো না নিশ্চয়ই!)
ঘটনা- ১১
শান্তিনিকেতনে নতুন একটি ছেলে ভর্তি হয়েছে, তার নাম ভাণ্ডারে। ছেলেটির সঙ্গে তখনও রবীন্দ্রনাথের পরিচয় হয়নি। রবীন্দ্রনাথ একদিন শান্তিনিকেতনের পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, তার পরনে দীর্ঘ আলখাল্লা, মাথায় টুপি। ভাণ্ডারে তাকে দেখে ছুটে গিয়ে হাতে আধুলি মানে আটআনা পয়সা দিয়ে এল। অন্য ছেলেরা জিজ্ঞাসা করল, ‘গুরুদেবকে তুই কী দিলি?’
‘গুরুদেব কোথায়? ও তো একজন ফকির। মা বলেছে ফকিরকে দান করলে পুণ্যি হয়।’ ভাণ্ডারের সাফ জবাব।
যা হোক, অল্পদিনেই বোঝা গেল ভাণ্ডারে ভীষণ দুরন্ত ছেলে। তার দৌরাত্মিতে ছাত্র শিক্ষক সবাই অস্থির। নালিশ গেল গুরুদেবের কাছে। গুরুদেব তাকে ডেকে বললেন, ‘ভাণ্ডারে তুই কত ভালো ছেলে। তুই একবার আমাকে একটা আধুলি দিয়েছিলি। কেউ তো আমাকে একটা পয়সাও কখনও দেয় না। তুই যদি দুরন্তপনা করিস, তা হলে কি চলে?’ গুরুদেবের কথায় ভাণ্ডারের দুষ্টুমি কিছুটা কমেছিল।
ঘটনা- ১২
রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের বকাঝকার পক্ষপাতি ছিলেন না। তিনি কাউকে কখনও আঘাত দিতে চাইতেন না। একবার প্রমথনাথ বিশী সম্পর্কে একটা নালিশ এল। এমন অবস্থা যে, তাকে না বকলেই নয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও গুরুদেব প্রমথকে অনেকক্ষণ ধরে বকলেন। তিনি একটু থামলে প্রমথ বললেন, ‘কিন্তু ঘটনা হল আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না।’ রবীন্দ্রনাথ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বললেন, ‘বাঁচালি। তোকে বকাও হল আবার তুই কষ্টও পেলি না।’
ঘটনা- ১৩
রবীন্দ্রনাথ একবার এক ভদ্রলোককে বললেন, ‘আপনাকে আমি দণ্ড দেব।’
ভদ্রলোক তো ভীষণ বিব্রত। না জানি কী অপরাধ হয়েছে তার। বললেন ‘কেন, আমি কী অপরাধ করেছি?’
রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘গতকাল আপনার লাঠি মানে দণ্ডটা আমার এখানে ফেলে গিয়েছিলেন। এই নিন আপনার দণ্ড।’ বলে তার দিকে লাঠিটা বাড়িয়ে ধরলেন।
ঘটনা- ১৪
একবার এক ঘরোয়া আসর জমেছে। সবাই হাসি গল্পে মশগুল। রবীন্দ্রনাথ বললেন, এ ঘরে একটা ‘বাঁদোর আছে।’
সবাই এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। গুরুদেব কাকে বাদর বললেন। রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়ে দিলেন, ‘এ ঘরে দুটো দরজা বা দোর। একটা ডান দিকে অন্যটা বাম দিকে। তাই বলছিলাম এ ঘরে একটা বাঁদোর রয়েছে।’
ঘটনা- ১৫
রবীন্দ্রনাথ তার ভক্ত ও ছাত্রছাত্রীদের সামনে গান গাইছেন, ‘হে মাধবী, দ্বিধা কেন?’
তখন ভৃত্য বনমালী আইসক্রিমের প্লেট নিয়ে তার ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বনমালী ভাবছে ঘরে ঢুকবে কি ঢুকবে না। কারণ রবীন্দ্রনাথ গান গাইছেন, এ সময় বিরক্ত হবেন কিনা কে জানে। গুরুদেব বনমালীর দিকে তাকিয়ে গাইলেন ‘হে মাধবী, দ্বিধা কেন?’ বনমালী আইসক্রিমের প্লেট গুরুদেবের সামনে রেখে লজ্জায় ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘বনমালীকে যদিও মাধবী বলা চলে না। তবে তার দ্বিধা মাধবীর মতোই ছিল। আর আইসক্রিমের প্লেট নিয়ে দ্বিধা করা মোটেই ভালো নয়।’
ঘটনা- ১৬
একবার রবীন্দ্রনাথ ঘুমুচ্ছেন। ঘরের জানালা খোলা। জানালা দিয়ে চাঁদের আলো আসছে। ফুটফুটে জ্যোৎস্না। আলোতে ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ ভৃত্য মহাদেবকে ডেকে বললেন, ‘ওরে মহাদেব, চাঁদটাকে একটু ঢাকা দে বাবা।’ মহাদেব তো হতভম্ব। চাঁদ সে কীভাবে ঢাকা দেবে? গুরুদেব হেসে বললেন, ‘জানালাটা বন্ধ কর, তাহলেই চাঁদ ঢাকা পড়বে।’
ঘটনা- ১৭
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বানান সংস্কারের জন্য একটা কমিটি গঠন করে দিলে সেই কমিটি বাংলা বানানের পুরনো রীতি পাল্টে নতুন বানানরীতি চালু করে। এই কমিটি এই কাজ করতে গিয়ে ‘গরু’ বানান নিয়ে সমস্যায় পড়ে। কমিটি ঠিক করে যে ‘গরু’ বানানটি গরু না লিখে ‘গোরু’ লেখা উচিত। কারণ শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃতের ‘গো’ শব্দ থেকে। আদিতে ‘ও’ কার, সেজন্য এখানেও ‘ও’ কার থাকা উচিত। কিন্তু সমস্যা হয়েছে, প্রায় সব বাংলাভাষী লেখক, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক সবাই ‘ও’ কার ছাড়া গরু বানান লেখেন। কিন্তু কী করা যায়! কমিটির সিদ্ধান্ত হলো, এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের মত নেয়া দরকার। দেখা যাক, উনি কী বলেন। কমিটির প্রধান ছিলেন ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। তাঁর নেতৃত্বে কমিটির লোকজন চলল শান্তিনিকেতনে। সেখানে গিয়ে তাঁরা সাক্ষাত প্রার্থী হলেন কবির।
কবি সাক্ষাত দিলেন এবং তাদের আগমনের হেতু জানতে চাইলে তাঁকে বিষয়টি বোঝানো হলো। বলা হলো, আমরা আপনার মত জানতে এসেছি। রবীন্দ্রনাথ কথাটা শুনে মৃদু হেসে বললেন, ‘তা তোমাদের ও-কার দিয়ে গরু লেখার ব্যাপারে অন্তত একটা সুবিধাই হবে যে, আমাদের দেশের জীর্ণকায় হাড় জিরজিরে গরুগুলোকে অন্তত একটু মোটা ও তাজা দেখাবে!’
ঘটনা- ১৮
একবার এক ভদ্রলোক রবীন্দ্রনাথের কাছে কলম ধার চাইলেন। তিনি কলম চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি এই কবিতার দ্বিতীয় লাইনটা জানেন? প্রথম লাইনটা হচ্ছে ‘সকল পক্ষী মৎস্য ভক্ষী, মৎস্যরাঙ্গী কলঙ্কিনী’।
রবীন্দ্রনাথ কলমটা দিয়ে বললেন, ‘নিশ্চয়ই জানি। লাইন দুটো দাঁড়াল এ রকম : সকল পক্ষী মৎস্য ভক্ষী, মৎস্যরাঙ্গী কলঙ্কিনী। সবাই কলম ধার চেয়ে নেয়, আমিই শুধু কলম কিনি!’
ঘটনা- ১৯
সুধাকান্ত রায়চৌধুরীর সাথে রবীন্দ্রনাথ একবার বেড়াচ্ছিলেন । হঠাৎ গুরুদেবের কাতরক্তি শুনে সুধাকান্তবাবু তারদিকে তাকাতেই, রবীন্দ্রনাথ নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘পা-কে চরনকমলবা পাদ-পদ্ম কেনকলে জান?’ প্রশ্ন শুনে সুধাকান্তবাবুর চোখে বিস্ময় দেখে রবীন্দ্রনাথ পায়ের মোজা খুলতে খুলতে বললেন ‘তাই যদি না হয়, তাহলে শরীরের এত জায়গা থাকতে মোজা ভেদ করে মৌমাছিটা পায়ের একেবারে তলায় হুলটা বিঁধালো কেন!’
ঘটনা- ২০
জীবনের শেষ দিকে এসে রবীন্দ্রনাথ একটু সামনের দিকে ঝুঁকে উবু হয়ে লিখতেন। একদিন তাঁকে ওভাবে উবু হয়ে লিখতে দেখে তাঁর এক শুভাকাঙ্ক্ষী বলল, ‘আপনার নিশ্চয় ওভাবে উপুড় হয়ে লিখতে কষ্ট হচ্ছে। বাজারে এখন এ রকম অনেক চেয়ার আছে যেগুলোতে আপনি হেলান দিয়ে বেশ আয়েশের সঙ্গে লিখতে পারেন। ওরকম একটা আনিয়ে নিলেই তো পারেন।’ লোকটার দিকে খানিকক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রবীন্দ্রনাথ জবাব দিলেন, ‘তা তো পারি। তবে কি জানো, এখন উপুড় হয়ে না লিখলে কি আর লেখা বেরোয়! পাত্রের জল কমে তলায় ঠেকলে একটু উপুড় তো করতেই হয়।’