আমরা যারা শিক্ষার্থী সবারই পড়াশোনার জন্য নির্দিষ্ট একটি রুটিন দরকার। প্রথম শ্রেনী থেকে ভার্সিটি যেখানকার শিক্ষার্থীই হই না কেন। দৈনিক পড়ার রুটিন থাকলে, সময়ের অপব্যহার কম হয়। পড়াশোনার জন্য তাই সময় ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। এর মধ্যে অনেকে আছেন রুটিন খাতায় লিখে, টেবিলের সামনে লাগিয়ে রাখে। আবার কেউ আছে নিজের ব্রেইনেই তৈরি করে রাখে।
যদিও বুদ্ধিমানের কাজ হলো, টেবিল বা চোখের সামনে পরে এমন স্থানে রুটিন তৈরি করে লাগিয়ে রাখা। কেননা, এর ফলে প্রতিবার রুটিনে চোখ পরার সাথে সাথে আপনার ব্রেইন সিগনাল কি করতে হবে। ফলে, সময়ের অপব্যবহার কম হবে। মোটকথা আপনার প্রডাক্টিভিটি, টাইম মেনেজমেন্ট, দুশ্চিন্তা মুক্ত রাখতে এমনকি পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করতে সহায়তা করবে।
সুতরাং, এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস সম্পর্কে না জানাটা বোকামী। তো কীভাবে দৈনিক পড়ার রুটিন তৈরি করবেন, এই নিয়েই আজকের আলোচনা। বলে রাখা ভাল, দৈনিক পড়ার রুটিন তৈরির নিয়ম দেয়ার পাশাপাশি আমরা একটা ডেমো রুটিন ও ৮ ঘন্টা পড়ার রুটিন শেয়ার করবো। তো চলুন, শুরু করা যাক।
দৈনিক পড়ার রুটিন তৈরির নিয়ম
এক নজরে সম্পূর্ণ লেখা দেখুন
১. প্রথম কাজ
দৈনিক পড়ার রুটিন তৈরি করার ক্ষেত্রে আপনার প্রথম কাজ হচ্ছে আপনি সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে শুরু করে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত যেসকল কাজগুলো করেন সেগুলো একটি একটি করে তালিকাবদ্ধ করা। যেমন ধরুনঃ
প্রার্থনা করা
ব্যায়াম করা
স্কুলে যাওয়া
সকাল, দুপুর এবং রাতের খাবার খাওয়া
খেলাধুলা করা
বিশ্রাম নেয়া ইত্যাদি
এরপর আপনার বাকি কাজগুলোর তালিকা করবেন। অর্থাৎ যেগুলো সাধারণত বিনোদনের জন্য করে থাকেন। যেমন- বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া, রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবার খাওয়া, বাইক নিয়ে ঘোরা, মোবাইল ফোন ব্যবহার করা ইত্যাদি।
২. দ্বিতীয় কাজ
এখন দেখুন যে, দিনের চব্বিশ ঘন্টা থেকে ঠিক কত ঘন্টা সময় আপনার হাতে আছে। স্কুল/ কলেজ/ ভার্সিটি যাওয়া থেকে শুরু করে সবটুকু কাজের সময় বাদ দিয়ে হাতে আর কতটুকু সময় বাকি থাকে, তা হিসাব করুন।
এবার আপনার যে কাজগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ বা গুরুত্বপূর্ণ নয় সেগুলোকে তালিকা থেকে একটু একটু করে বাদ দিন। যেমন-
বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া।
মোবাইল ফোন অতিরিক্ত ব্যবহার করা।
টিভি দেখা।
এগুলোকে বাদ দিন। এবার আপনার হাতে যতটুকু সময় বাকি আছে সেটুকুই হবে আপনার পড়ার সময়। এই সময়টুকুকে এরপর তিনটি ভাগে ভাগ করুন। সকালের জন্য, দুপুর/ বিকালের জন্য, রাতের জন্য।
দৈনিক পড়ার রুটিন তৈরির নিয়ম
দৈনিক পড়ার রুটিন তৈরির নিয়ম
৩. তৃতীয় কাজ
এবার আপনার শ্রেনীর যে কয়টি বিষয়, তার একটি তালিকা করুন। এখন থেকে যেসকল বিষয়ে আপনি একটু কাঁচা সে বিষয়গুলো নির্বাচন করুন। সেগুলোতে তুলনামূলক একটু বেশি সময় দেয়া আবশ্যক। তবে সহজ বিষয়গুলো বাদ দেয়া যাবে না।
এমনভাবে রুটিন করতে হবে যাতে পড়াশেনার সময়টাও হয় পারফেক্ট। কিছু কিছু সময় আছে যখন পড়তে বসলে মাথা কাজ করে না। এগুলো নিয়ে নিচে আলোচনা করছি।
৪. চতুর্থ কাজ
আপনাকে সময় নির্বাচন করার ক্ষেত্রে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। সকাল ৪-৫টা এই সময়টা আমাদের ব্রেইন থাকে সবচেয়ে বেশি পরিমানে সক্রিয়। মূলত কোনো কিছু মেমোরাইজিং করার জন্য এটা একটা পারফেক্ট টাইম। আর রাত ১০-২ টা পর্যন্ত সময় টুকুতে আমাদের ব্রেইন ওয়াশ হয়। এতে এই সময়ে পড়ার চাইতে সকালের পড়া বেশি কার্যকর।
তাই আপনি যে সকল বিষয়ে একটু দুর্বল, সেই বিষয়গুলো সকালের দিকে পড়বেন। তবে ৪ টা থেকে পড়ার প্রয়োজন নেই। ৫ টার সময় প্রার্থনা শেষ হলে সাড়ে ৫ টা থেকে পড়া শুরু করতে পারেন। আর এতে একটু অসুবিধা থাকলে ছয়টার দিকেও শুরু করতে পাড়েন। আর রাতের দিকে কখনো কঠিন বিষয় পড়বেন না। কিংবা যা একটু জটিল সে ধরনের পড়া পড়বেন না। কারন, এটা ব্রেইনে চাপ দেয়, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। তাই এটার ইমপ্যাক্ট সরাসরি কুফল বয়ে আনে। রাতে ঘুম আসে না জেনে নিন তাড়াতাড়ি ঘুমানোর উপায়
৫. পঞ্চম কাজ
অনেকে রুটিন করার ক্ষেত্রে আলাদা সময় নির্বাচন করে। উদহরন দিয়ে বোঝাই। যেমন- ৬-৬.৩০ পর্যন্ত বাংলা পড়ব, ৬.৩০-৭ টা পর্যন্ত গনিত করব, ৭-৭.৪০ পর্যন্ত রসায়ন পড়ব। এই টাইপের রুটিন করা যাবে না।
বরং আপনাকে রুটিন করতে হবে টাস্ক অনুযায়ী। যেমন- আপনি টার্গেট নিলেন যে ৬ টা থেকে শুরু করলে, ৬ টায় আপনি বাংলা বইয়ের একটা গল্পের সৃজনশীল প্রশ্ন পড়বেন। এখন এখানে সময় নির্বাচন করবেন না। অর্থাৎ এটা পড়তে আপনার আধ ঘন্টাও লাগতে পারে, একটু বেশি সময়ও লাগতে পারে। আবার এটা শেষ হলে ইংরেজীর একটা প্যারাগ্রাফ কমপ্লিট করলেন, এই ধরনের টাস্ক আরকি। তবে বিষয়গুলো নির্বাচন করে রুটিনে লিখতে হবে। এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পরতে হবে।
৬. ষষ্ঠ কাজ
পড়ার সময় যে কাজগুলো করবেন না:
রুটিনে দুইটি বিষয় স্পষ্টভাবে উল্লেখ রাখবেন। এই দুইটি কাজ পড়ার সময় করলে আপনার রুটিনের নিয়ম ভঙ্গ হয়ে পড়ায় ফাটল ধরে যাবে।
i. শান্ত পরিবেশে পড়াশোনা করুন
আপনি যেখানে পড়াশোনা করবেন সেই পরিবেশটা হতে হবে কোলাহল মুক্ত। কারন যদি শব্দ হয়, তাহলে এটা সরাসরি ব্রেইনে প্রতিক্রিয়া করে। তাই আমাদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে। এবং যদি প্রয়োজন হয় তবে দরজা বন্ধ করেও পড়তে পারেন।
আর একটা বিষয় হলো, আপনি চাইলে আপনার রুমের মধ্যে ফুলের বিভিন্ন গাছ রাখতে পারেন। এর ফ্রেশনেস আপানাকে পড়াশোনায় কনসেন্ট্রেট করতে সাহায্য করবে।
ii. মোবাইল ফোন দূরে রাখতে হবে-
এটা হচ্ছে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর একটি বড় সমস্যা। মোবাইল ফোন যদি কাছে থাকে একটু পরপর ইচ্ছে হয় নোটিফিকেশনগুলো চেক করতে। আবার দেখা গেছে মোবাইল ফোনে, একটা কিছু কথা মনে পড়ে গেলো, ইউটিউবে এই ভিডিওটা দেখে নিই।
আবার কেউ হয়তো ফেসবুকের কোন একটি নোটিফিকেশন টা চেক করতে চাইল। এরকম কিছু বিষয় মাথায় ঘুরতে থাকে। তো, এই আসক্তি বর্তমান জেনারেশনে একটু স্বাভাবিক। এবং এই কারণে ফোনটা যথাসম্ভব হাতের কাছ থেকে দূরে রাখতে হবে। এরপর আপনি সম্পূর্ণরূপে আপনার মনোযোগ টুকু পড়াশোনায় বসাতে পারবেন।
৭. সপ্তম কাজ
আপনি যখন রুটিন তৈরি করবেন, সপ্তাহের ছয়দিন এর জন্য তৈরি করবেন। এবং সপ্তম দিনে সেই ছয় দিনের সব পড়াটুকু গুছিয়ে রিভিশন করবেন। এতে করে পড়াটা চমৎকারভবে মনে থাকবে। সম্ভব হলে সপ্তাহে নিজেই নিজের একটি করে মডেল টেস্ট নেবেন। এতে দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে।
রুটিন কোথায় রাখবেন?
অনেকে রুটিন তৈরি করেন। ঘন্টা খানেক পড়ে দেখা গেল খুঁজে পেলেন না। তো, কেউ আবার ব্যাগের মধ্যে রেখে দেন। কেউবা ভাঁজ করে রেখে দেন বইয়ের মধ্যে। তো এভবে করলে রুটিন ফলো করা যাবে না।
পড়াশোনাটা যেহেতু পড়ার টেবিলে হচ্ছে, তাই রুটিনটাকেও রাখতে হবে টেবিলে। আবার টেবিলের পাশে লাগোয়া দেয়ালেও ঝুলিয়ে রাখে পারেন। তবে এমন স্থানে রাখতে হবে, যাতে এটা চোখে পড়ে সবসময়।
রুটিন ফলো করতে সমস্যা হচ্ছে? কীভাবে ফলো করবেন?
প্রথম প্রথম এরকমটা স্বাভাবিক। হঠাৎ করেই তো আর কোনো কিছুতে অভ্যস্থ হওয়া যায় না। তবে কিছু উপায় আছে। যেমন পড়তে বসলেই একবার রুটিনে চোখ বোলাবেন। একটি বই যখন পড়েন তখন অন্য বইয়ের চিন্তা মাথায় আনবেন না।
এতে দেখা গেল সেই বই অন্য বইটি পড়া শুরু করলেন। গল্পের বই, ম্যাগাজিন এসব একটু দূরে রাখবেন। এতে পড়ায় ভালোভাবে মন বসাতে পারবেন। তাই অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আপনি রুটিন অনুযায়ী পড়াশোনায় হয়ে উঠবেন অভ্যস্থ। এরপর যা কিছই আপনার পাশে থাকুক না কেন, দেখবেন যে এখন মনযোগটুকু পড়ার দিকেই থাকবে।