বিনোদনের নতুন মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। করোনাকালীন ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জনপ্রিয়তা বেড়েছে আকাশচুম্বী। বেশ কিছু কারণে মানুষ এখন টেলিভিশনের ওপর আস্থা হারিয়ে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম- নেটফ্লিক্স, অ্যামাজান, ডিজনি হটস্টার, হৈচৈ, বঙ্গ ইত্যাদির ওপর ঝুঁকে পরেছে।
বাংলাদেশে সিনেমা, নাটক ও সংগীতাঙ্গনে চোখে পড়ার মতো বিবর্তন ঘটেছে। বিনোদনমূলক কন্টেন্ট উপভোগের বিকল্প মাধ্যম জনপ্রিয়তা পেয়েছে। শিল্পীদের কাজের পরিধি বেড়েছে। একইসঙ্গে বাজার বড় হচ্ছে। ফলে আশার ফুল ফুটেছে বিনোদনের বাগানে।
বাংলাদেশে সিনেমা আগের মতো এফডিসিকেন্দ্রিক নেই। এফডিসির বাইরেই বেশিরভাগ কাজ হচ্ছে ইদানীং। সিনেমাহল ছাড়াও ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে। ওটিটিতে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে ওয়েব সিরিজও। সেই সূত্র ধরে বলা যায়, নাটক এখন আর কেবল টেলিভিশন চ্যানেলনির্ভর নয়। ইউটিউবেই একক নাটক প্রকাশিত হচ্ছে বেশি।
অন্যদিকে গান-বাজনা তৈরির জন্য শিল্পীরা এখন আর বাণিজ্যিক স্টুডিওতে যান না। তাদের ঘরে ঘরে এখন স্টুডিও সেটআপ। একইভাবে বলা যায়, কনসার্ট রূপ নিয়েছে কোক স্টুডিও বাংলার মতো প্ল্যাটফর্মে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এগুলো প্রযুক্তির উৎকর্ষতা ও সহজলভ্যতার সুফল।
এসব বিবর্তনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। বাংলাদেশে এখন এমন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের সংখ্যা ১১টি। এগুলো হলো চরকি, বঙ্গ বিডি, বিঞ্জ, বায়োস্কোপ, সিনেম্যাটিক, আই স্ক্রিন, দীপ্ত প্লে, বাংলাফ্লিক্স, টফি, টেলিফ্লিক্স এবং সিনেস্পট। এছাড়া বাংলাদেশে এখন দেখা যাচ্ছে নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম ভিডিও, হইচই, আড্ডা টাইমস, ডিজনি প্লাস হটস্টার প্রভৃতি বিদেশি ওটিটি। করোনাকাল থেকে অনলাইনে নাটক, সিরিজ ও সিনেমা দেখার প্রতি দর্শকের আগ্রহ তৈরি হয়। দিনে দিনে সেটি বেড়েছে।
সারাবিশ্বেই এখন ওটিটির জনপ্রিয়তা আছে। বাংলাদেশে সেই হাওয়া লাগবে, এটাই স্বাভাবিক। এর সুবিধা হলো ঘরে-বাইরে যেখানে ইচ্ছা ইন্টারনেটের মাধ্যমে স্মার্টফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ কিংবা স্মার্ট টিভিতে যেকোনো সময় বিজ্ঞাপন ছাড়াই কন্টেন্ট দেখা যায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি আরও বেশি উপযোগী। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় ট্রাফিক জ্যামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। তখন ওটিটিতে কন্টেন্ট দেখে সময় কাটছে অনেকের। বাসায় ফিরে সেই কন্টেন্টের পরের অংশ থেকে আবারও দেখা শুরু করা যায়। তাছাড়া সিঙ্গেল স্ক্রিন সিনেমাহলের পরিবেশ দর্শকবান্ধব নয়। সেই সঙ্গে যানজটসহ আরও অনেক ঝক্কি তো আছেই। এর চেয়ে ড্রইং রুমে আরাম করে ওটিটিতে কন্টেন্ট দেখা দর্শকদের কাছে বেশি উপভোগ্য।
দর্শকদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা মধ্যে রয়েছে-
মোবাইলে একটা ক্লিক করলেই ওটিটি প্ল্যাটফর্মে দেখা যাচ্ছে পছন্দের সিনেমা এবং সিরিজগুলো। নিজের সময়মতো দেখার সুযোগ রয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে। টেলিভিশনে কোন একটি জিনিস দেখতে গেলে তাদের নির্ধারিত সময়মতো দেখতে হতো কিন্তু ওটিটি প্ল্যাটফর্মে নিজের ছুটির দিনে সময় করে দেখার সুযোগ রয়েছে বলেই এই মাধ্যম দর্শক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
এছাড়া এই প্ল্যাটফর্মে মিশ্র ধরণের ছবি ও সিরিজ রিলিজ দেয়া হয়। দর্শকদের তাই পছন্দমতো জিনিস বেছে নেবার অনেক সুযোগ থাকে। কারো হরর মুভি পছন্দ, কারো রোমান্টিক কারো ক্রাইম-থ্রিলার । দর্শকদের জন্য এই প্ল্যাটফর্মে তাদের টেস্ট অনুযায়ী বেছে নেবার সুযোগের কারণে এটি জনপ্রিয়।
এছাড়া টেলিভিশনে কোন কিছু দেখতে বসলে বিজ্ঞাপনের জন্য সেটি শেষ পর্যন্ত দেখার ধৈর্য থাকেনা। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপনের ঝামেলা নেই তাই দর্শকরা স্বল্প সময়ে সিনেমা অথবা সিরিজ উপভোগ করতে পারে। আর এটিও দর্শক জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ।
প্রায় নেটফ্লিক্সের সমসাময়িক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছিল অ্যামাজন প্রাইম এবং হুলু। কিন্তু তাদের বাজার এবং সংগ্রহশালা ছিল সীমিত। আর নেটফ্লিক্সের সমান ঝুঁকি নেওয়ার সাহসও কখনোই দেখায়নি তারা। যার ফলে আরও কিছুকাল অব্যাহত থাকে নেটফ্লিক্সের একচেটিয়া ব্যবসা।
তবে ২০১৫-১৬ সাল পর্যন্ত নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয়তা দেখে বিনোদন জগতের হর্তাকর্তারা নিশ্চিত হয়ে যান, অনলাইন স্ট্রিমিংই টিভির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। তারা বুঝতে পারেন যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করতে পারলে টেলিভিশনের ভবিষ্যৎ হয়ে যাবে শুধুই নেটফ্লিক্স।
এ সময়ে ইউটিউব এবং ফেসবুকও তাদের নিজস্ব স্ট্রিমিং প্লাটফর্ম খোলার সিদ্ধান্ত নেয়। নড়েচড়ে বসে নেটফ্লিক্সের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যামাজন প্রাইম ও হুলু। বাজেট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় এই ২ প্রতিষ্ঠান। তাদের সংগ্রহশালায় যোগ হতে থাকে নামি দামি সব কন্টেন্ট।
গত ৩-৪ বছরে আরও ডজন খানেক নেটওয়ার্ক নাম লিখিয়েছে এই স্ট্রিমিং জগতে। ডিজনি প্লাস, এইচবিও ম্যাক্স, পিকক, স্লিং ও ফুবো তাদের মধ্যে অন্যতম।
বর্তমানে বিশ্বের ১৯০টিরও বেশি দেশে সম্প্রচারিত হয় নেটফ্লিক্স। ডার্ক (জার্মান), স্যাক্রেড গেমস (হিন্দি), এলিট (স্প্যানিশ)-এর মতো সিরিজগুলো দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল ও ভাষাভাষী দর্শকের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে নেটফ্লিক্স। সাফল্যও পাচ্ছে।
তবে নেটফ্লিক্স একা না; এইচবিও ম্যাক্স, ডিজনি প্লাসও তাদের বৈশ্বিক বাজার বিস্তৃত করে চলেছে। অ্যামাজন প্রাইম ইতোমধ্যে নেটফ্লিক্সের সঙ্গে একরকম প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে বৈশ্বিক বাজারে। মুভি, সিরিজের পাশাপাশি স্ট্রিমিং সার্ভিসগুলোতে জায়গা করে নিচ্ছে খেলাধুলা, টক শো, রিয়েলিটি শোর মতো কনটেন্ট। অচিরেই হয়তো বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হয়ে উঠবে স্ট্রিমিং সার্ভিস।
জরিপ অনুযায়ী, গড়পড়তা মার্কিনিরা এখন টিভির চেয়ে স্ট্রিমিং সার্ভিসগুলোতে বেশি সময় ও অর্থ ব্যয় করে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র না, প্রথম বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই ধীরে ধীরে টিভির স্থান দখল করছে স্ট্রিমিং সার্ভিসগুলো। গতানুগতিক টিভি চ্যানেলগুলোও পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে খুলছে নিজেদের স্ট্রিমিং সার্ভিস। আমাদের দেশেও কিন্তু দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে স্ট্রিমিং সার্ভিস। পাশের দেশে হটস্টার, হইচইয়ের সাফল্যের পর বাংলাদেশেও এখন এই মডেলের কিছু স্ট্রিমিং সার্ভিস আত্মপ্রকাশ করেছে। বঙ্গ, বায়স্কোপ, চরকি তাদের মধ্যে অন্যতম।
https://bangla-bnb.saturnwp.link/%e0%a6%87%e0%a6%95%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%b8-%e0%a6%ac%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%ac%e0%a6%b8%e0%a6%be/
মিডিয়ার সদা-পরিবর্তনশীল এই বাজারে কখনোই নিশ্চিতভাবে বলা যায় না ভবিষ্যৎ কেমন হবে। তবে, নেটফ্লিক্সের কারণে আমাদের বিনোদন গ্রহণের মাধ্যম যে চিরতরে বদলে গেছে, তা বলে দেওয়া যায়। গত এক দশকে বিনোদন জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা এই স্ট্রিমিং সার্ভিসের দেখানো পথে অন্তত আরও কয়েকবছর হাঁটবে বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো।