কোনো বস্তুর রং আমরা কী দেখতে পাবো, তা নির্ভর করে আমাদের দেখার পদ্ধতির ওপর। আমাদের চোখের রেটিনায় দুই ধরনের কোষ থাকে। এদের বলা হয় রড কোষ ও কোন কোষ। রাতে বা স্বল্প আলোয় দেখার জন্য রড কোষ কাজ করে। আর উজ্জ্বল আলোয় কাজ করে কোন কোষ। এই কোষগুলো রং শনাক্ত করে। বেশিরভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণীর চোখে দুই ধরনের কোন কোষ থাকলেও মানুষের চোখে আছে তিন ধরনের।
সেগুলো এল, এম এবং এস নামে পরিচিত। এই কোষগুলো যথাক্রমে দৃশ্যমান আলোর দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্য বা লাল, মাঝারি তরঙ্গদৈর্ঘ্য বা হলুজ ও সবুজ এবং ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্য বা সবুজ রং দেখার জন্য কাজ করে। এল-কোনকে লাল কোন কোষও বলা হয়। কারণ, এরা দীর্ঘ বা লম্বা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের প্রতি সংবেদনশীল (বেশিরভাগ স্তন্যপায়ীর চোখে এটি নেই)। এম-কোনকে বলা হয় সবুজ কোণ, কারণ তা দৃশ্যমান আলোর মাঝারি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের প্রতি সংবেদনশীল। আর এস-কোনকে বলা হয় নীল কোন, কারণ তা দৃশ্যমান তরঙ্গদৈর্ঘ্যের প্রতি সংবেদনশীল।
চোখের রেটিনায় প্রায় ৬০ থেকে ৭০ লাখ কোন কোষ আছে, অন্যদিকে রড কোষ আছে প্রায় ৬০ লাখ থেকে ১ কোটি ২০ লাখ। আমাদের মস্তিষ্ক এসব কোষ থেকে পাওয়া সংকেত একত্রিত করে হাজারো রঙের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারে। কথাটা যত সহজে বললাম, পুরো প্রক্রিয়াটা ততটাই জটিল। কোনো আলো কোন কোষগুলোয় আঘাত করলে বিভিন্ন রঙের আলোর তীব্রতা কেমন, সে সংকেত মস্তিষ্কে পৌঁছায়।
সেগুলো তুলনা করে, মস্তিষ্ক এদের রং হিসেবে ব্যাখ্যা করে। যেমন যদি এস (বা নীল) ও এম কোন (বা সবুজ) কোষগুলো শক্তিশালীভাবে সক্রিয় হয়, কিন্তু এল (বা লাল)-এর সক্রিয়তা কম থাকে, তাহলে চোখে সবুজাভ রং দেখা যাবে। আবার এস ও এম কোনগুলো কম সক্রিয় হলে এবং এল শক্তিশালী হলে লালচে রং দেখা যাবে। আর দৃশ্যমান বর্ণালী থেকে আসা আলোর সবগুলো যদি সমান উজ্জ্বল হয়, তাহলে আমরা সাদা রং দেখার অনুভূতি পাই। সূর্যের ক্ষেত্রেও ঠিক এটাই ঘটে। অর্থাৎ লাল, নীল ও সবুজ শক্তিশালীভাবে সক্রিয় হয়। তাই সূর্য দেখায় সাদা।
অবশ্য কথাটা আংশিকভাবে সত্য। উত্তরটা মহাকাশে বা আমাদের বায়ুমণ্ডলের ধুলিকণা ও অন্যান্য পদার্থে আঘাত করার আগে সূর্যের আলোর জন্য সত্য। নভোচারীরা মহাকাশে সূর্যকে সাদা দেখেন। কিন্তু সূর্যের আলো আমাদের পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল বা বাতাসের মধ্যে দিয়ে চলার সময় কিছুটা ঢং করে। মানে রং বদলায়। কারণ এ আলোর কিছুটা বাতাসে শোষিত হয় কিংবা ছড়িয়ে পড়ে। বাতাস বা বায়ুমণ্ডলে সব রং সমানভাবে প্রভাবিত হয় না।
যেমন লালের তুলনায় নীল রং বেশি ছড়িয়ে পড়ে বা বিক্ষিপ্ত হয়। তারও কারণ আছে। আসলে বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর (যেমন লাল) চেয়ে ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো (যেমন নীল) বায়ুমণ্ডলে বেশি ছড়ায়। তাই আকাশ নীল দেখা যায়। আমরা সূর্যের ছড়িয়ে পড়া এই আলোকে আকাশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসতে দেখি, যা আকাশকে রঙিন করে তোলে।
কিন্তু নীলের চেয়ে বেগুনি আলোর ছড়িয়ে পড়ার গুণ বেশি। তবুও আকাশকে বেগুনি দেখা যায় না কেন? তার কারণ সূর্য যতটা নীল আলো নিঃসরণ করে, ততটা বেগুনি আলো করে না। সূর্য থেকে বেগুনি আলো তুলনামূলক কম নিঃসৃত হয়। আবার আমাদের চোখও বেগুনির প্রতি অতটা সংবেদনশীল নয়। তাই আকাশ বেগুনি দেখায় না।
আবার সূর্যের আলোতে নীলের চেয়েও বেশি থাকে সবুজ রং। তবু আকাশকে ঘাসের মতো সবুজময় হতে দেখি না কেন? তার কারণও প্রায় একই। মানে সবুজের চেয়ে নীল আলো বেশি ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি লালের চেয়েও বেশি ছড়ায় নীল। এই রংটা যদি সূর্যের আলো থেকে হটিয়ে দেওয়া যেত, তাহলে আকাশ দেখাতো হিমু রঙের। মানে হলদে।
তাছাড়া আমাদের মস্তিষ্ক রংকে ব্যাখ্যা করে আপেক্ষিকভাবে। কোনো দৃশ্য দেখার সময় আমরা এক বস্তুকে অন্যগুলোর সঙ্গে তুলনা করে দেখি। তাই আকাশ যদি নীল দেখায়, তাহলে সূর্যকে কিছুটা হলুদ দেখাতে পারে। কিন্তু সূর্যের রং অনেকেই হলুদ বলে দাবি করলেও তা সত্যি নয়। তাই যদি হতো, তাহলে সূর্যের আলোতে একটা সাদা কাগজকে দেখাত হলদে। কারণ সাদা কাগজ সব আলোই ভালোমতো প্রতিফলিত করতে পারে। তাই সাদা কাগজ থেকে হলুদ রংই প্রতিফলিত হতো। কিন্তু সেটা আসলে সাদাই দেখায়।
তাহলে প্রশ্ন জাগে, সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের সময় সূর্যকে হলুদ বা লাল দেখায় কেন? আসলে দিগন্তের কাছে সূর্য থাকলে তার আলোকে আমাদের চোখে পৌঁছাতে বায়ুমণ্ডলের ভেতর দিয়ে অনেক বেশি পথ পাড়ি দিতে হয়। এ সময়ও নীল আলোই বেশি বিক্ষিপ্ত হয়, কিন্তু এখানে পথ পাড়ির দেওয়ার ক্ষেত্রে আসলে দৌড়ে জিতে যায় দীর্ঘ তরঙ্গের আলো। অর্থাৎ লাল বা হলদে আলো। তাই আমাদের চোখে লাল আলোটা পৌঁছাতে পারে। তাই এ সময় সূর্য বা আকাশ কিছুটা লালচে দেখায়।