ঋতু পরিবর্তনে ভাইরাস জ্বরের সঙ্গে বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে রয়েছে ডেঙ্গু রোগের দাপট। এই সময়ে শরীর সুস্থ রাখার জন্য রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। চিকিৎকরা শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর দিকে নজর দিতে বলছেন। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নিয়মিত ফল খাওয়া প্রয়োজন। কোন ফলটি শরীরের জন্য বেশি উপকারী তা জানা প্রয়োজন। শরীরের অনেক সমস্যা দূর করতে সুস্বাদু রসালো ফল আনারস সিদ্ধহস্ত। আনারস হচ্ছে ঔষধিগুণসম্পন্ন ফল। বিভিন্ন ভাইরাসের সংক্রমণের এই সময়ে খেতে পারেন রসাল ফল আনারস। আনারসে রয়েছে রোগ-প্রতিরোধী অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট। যা অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে। রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে আনারসের জুড়ি মেলা ভার। আনারস শরীরে পুষ্টির অভাব দূর করে। আনারসে ক্যালোরির পরিমাণও নেই বললেই চলে। যারা ওজন কমাতে চাইছেন, প্রতিদিনের পাতে রাখতে পারেন আনারস। ওজন থাকবে নিয়ন্ত্রণে।
আনারস বহুবর্ষজীবী ভেষজ উদ্ভিদ যার বৈজ্ঞানিক নাম আনানাস কমোসাস। গবেষকদের ধারণা আনারসের উৎপত্তিস্থল ব্রাজিলে। আনারস উৎপাদনে লিডিং দেশগুলোর মধ্যে আছে কোস্টারিকা, ব্রাজিল, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ইন্ডিয়া। পাইনগাছের শক্ত, শুষ্ক ফল অর্থাৎ ‘কোন’ এর সঙ্গে ইউরোপবাসী আনারসের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছিল। সে কারণে দক্ষিণ আমেরিকায় ইউরোপের অভিযাত্রীরা প্রথম এই ফল দেখে নাম রেখেছিল পাইনাপল (পাইন+আপেল)। সেটা ষোড়শ শতকের কথা। তখনকার অপরিচিত ফল আনারস এরপর খুব অল্প সময়েই সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশে আনারস আসে আনুমানিক ১৫৪৮ সালের দিকে। পৃথিবীতে আনারসের অনেক জাত থাকলেও বাংলাদেশে হানি কুইন, জায়েন্ট কিউ ও ঘোড়াশাল এই তিন জাতের আনারস চাষ হয়ে থাকে। হানি কুইন জাতের আনারস পার্বত্য জেলাগুলোতে ও শ্রীমঙ্গলে এবং জায়েন্ট কিউ জাতের আনারস মধুপুর অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয়ে থাকে। বাংলাদেশে আনারসের হানি কুইন ও জায়েন্ট কিউ এই দু’টি জাতই জনপ্রিয়। এই জাতের ফল অত্যন্ত সুমিষ্ট, কম আঁশযুক্ত, রসালো আকারে ছোট, স্বাদ ও গন্ধে সর্বোৎকৃষ্ট। অপরদিকে জায়েন্ট কিউ জাতের ফল আকারে বড় ও ওজনে ভারী। উঁচু জমি ও পানি দাঁড়ায় না দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি আনারস চাষের জন্য বেশ উপযোগী।
আনারসের জুস, স্লাইস, এসিড, স্কোয়াশ, সিরাপ, জ্যাম, জেলি, আনারসসত্ত্ব, ভিনেগার, সাইট্রিক এসিড, ক্যালসিয়াম সাইট্রেট, অ্যালকোহল বিশ্বনন্দিত। সর্দি জ্বর কাশির মহৌষধ আনারস। তাছাড়া আনারসের পাতা থেকে মোম ও সুতা তৈরি হয়। বাণিজ্যিক ফল হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে আনারস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পৃথিবীতে উৎপাদিত আনারসের বেশিরভাগই প্রক্রিয়াজাত করা হয়ে থাকে। প্রতি ১০০ গ্রামে আনারসে পাওয়া যায় ৫০ কিলোক্যালরি শক্তি। এতে ভিটামিন-এ, বি, সি, ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান রয়েছে। ১০০ গ্রাম আনারসে ০.৬ ভাগ প্রোটিন, ০.১২ গ্রাম সহজপাচ্য ফ্যাট, ০.৫ গ্রাম খনিজ পদার্থ, ১৩.১২ গ্রাম শর্করা, ০.১১ গ্রাম ভিটামিন বি-১, ০.০৪ মি. গ্রাম ভিটামিন-২, ভিটামিন- সি ৪৭.৮ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৮ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ০.০২ গ্রাম, আঁশ ১.৪ গ্রাম এবং ১.২ মিলি গ্রাম লৌহ রয়েছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক আনারসের কিছু গুণাগুণ সম্পর্কে যা আমাদের শরীরে বেশ উপকারে আসবে:
কিডনিতে পাথর সৃষ্টির ঝুঁকি কমায়
আনারস থেকে প্রাপ্ত আঁশ, পটাশিয়াম ও ভিটামিন সি হৃদযন্ত্রের সুস্থতা রক্ষা করে। উচ্চ মাত্রায় পটাশিয়াম গ্রহণ স্ট্রোক, হাঁড়ের ক্ষয়, বৃক্কে (কিডনি) পাথর সৃষ্টির ঝুঁকি কমায়। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, কিডনিতে পাথর হওয়ার সমস্যা দূরে রাখতে পারে আনারস। নিয়ম করে সেগুলো খেলে কিডনি ভালো থাকবে। অ্যাসিড-জাতীয় উপাদান ছাড়াও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ সাইট্রাস গোত্রের ফল আনারস কিডনিতে পাথর জমতে দেয় না এবং কিডনি সুরক্ষিত রাখে।
ক্যানসার প্রতিরোধী
আনারস ক্যানসার প্রতিরোধেও ভূমিকা রাখে বলে সাম্প্রতিক এক গবেষণা থেকে জানা গেছে৷ আনারস শরীরের ইমিউন কোষগুলোকেও সক্রিয় করে তোলে৷ দেহের কোষের ওপর ফ্রি-রেডিকেলের বিরূপ প্রভাবে ক্যানসার রোগ দেখা দিতে পারে। দেশি আনারসে থাকে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন-সি যা দেহকে ফ্রি-রেডিকেল থেকে আমাদের দেহকে মুক্ত রাখতে সাহায্য করে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে উপকারী
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনারস বেশ কার্যকরি। আপনার ডায়াবেটিস আছে বলে আনারস খাওয়া বন্ধ করবেন না ৷ এটি নিয়ন্ত্রণের অনেক ভালো উপায় রয়েছে । বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সকালের খাবারে পরিবর্তন আনলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা যায় । ওষুধ ও শারীরিক ব্যায়ামের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা যায় ।
সর্দি-কাশি-জ্বর থেকে রক্ষা করে
বছরের মধ্যে বেশির ভাগ দিনই সর্দি-কাশি, জ্বরে ভোগেন অনেকে। আনারসের রস খেয়ে দেখুন। আনারসে রয়েছে ভিটামিন সি, যা ঠান্ডা লাগার ধাত কমায়! ফলে একটুতেই সর্দি-কাশি-জ্বর বাঁধিয়ে বসার ভাবনা থাকে না!
রক্ত জমাটে বাধা দেয়
দেহে রক্ত জমাট বাঁধতে বাধা দেয় এই ফল। ফলে শিরা-ধমনির (রক্তবাহী নালি) দেয়ালে রক্ত না জমার জন্য সারা শরীরে সঠিকভাবে রক্ত যেতে পারে। হৃৎপিণ্ড আমাদের শরীরে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত সরবরাহ করে। আনারস রক্ত পরিষ্কার করে হৃৎপিণ্ডকে কাজ করতে সাহায্য করে।
সংক্রমণ দমন করে
আনারসে রয়েছে ব্রোমেলিন এনজাইম, যা সংক্রমণ দমন করে৷নিয়মিত আনারস খেলে খেলাধুলা করতে গিয়ে পাওয়া আঘাত বা ক্ষত সহজেই সেরে যায়৷
ওজন কমায়
শরীরের ওজন কমাতে হাতের কাছে রয়েছে আনারস! এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে। নিয়মিত এই ফলের রস খান, এতে ক্যালোরির পরিমাণও খুব সামান্য। ফ্যাট না থাকায় এই রস তাড়াতাড়ি ওজন কমাতে সহায়তা করে।
চোখের যত্নে
আনারসে থাকা বিটা ক্যারোটিন চোখের রেটিনা নষ্ট হয়ে ধীরে ধীরে অন্ধ হয়ে যাওয়া থেকে আমাদের রক্ষা করতে সাহায্য করে। তাই নিয়মিত আনারস খেলে এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়।
হজমশক্তি বাড়ায়
আনারস আমাদের হজমশক্তি বৃদ্ধি করতে বেশ কার্যকরী। আনারসে রয়েছে ব্রোমেলিন যা আমাদের হজমশক্তিকে উন্নত করতে সাহায্য করে। এতে থাকা শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন ‘এ’, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম এবং ফসফরাস দেহের পুষ্টির অভাব যেমন পূরণ করে, তেমনি কোষ্ঠকাঠিন্যও দূর করে৷
হাড়ের সুস্থতায়
আনারসে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও ম্যাংগানিজ। ক্যালসিয়াম হাড়ের গঠনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং ম্যাংগানিজ হাড়কে করে তোলে মজবুত। প্রতিদিনের খাবার তালিকায় পরিমিত পরিমাণ আনারস রাখলে হাড়ের সমস্যাজনিত যে কোনো রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
কৃমিনাশক হিসেবে
কৃমিনাশক হিসেবে আনারসের জুস ভালো কাজ করে। নিয়মিত আনারসের জুস খেলে কৃমির সমস্যা দূর করা সম্ভব।
প্রজনন ক্ষমতা উন্নত করে
এতে থাকা ভিটামিন সি, বিটা ক্যারোটিন, জিঙ্ক, কপার, ফোলেট পুরুষ ও মহিলা উভয়েরই প্রজনন ক্ষমতা উন্নত করতে সাহায্য করে।
দাঁত ও মাড়ির সুরক্ষায়
আনারসের ক্যালসিয়াম দাঁতের সুরক্ষায় কাজ করে। মাড়ির যে কোনো সমস্যা সমাধান করতে বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে। প্রতিদিন আনারস খেলে দাঁতে জীবাণুর আক্রমণ কম হয় এবং দাঁত ঠিক থাকে।
ত্বকের বয়স রোখে
আলফা হাইড্রক্সি অ্যাসিড বা এএইচএ থাকায় আনারস কোলাজেন উৎপাদন করতে সক্ষম। তাই আনারসের রস নিয়মিত মুখে মাখলে ত্বকের বলিরেখা সরে, বয়সের চাপ পড়ে না। আনারসের রস ত্বকে মিনিট পাঁচেক রাখার পর ধুয়ে নিন।
সাবধানতা
আনারসের কারণে নারীদের গর্ভপাত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। গর্ভাবস্থায় থাকলে নারীদের আনারস খেতে বারণ করা হয়। তাছাড়া গর্ভাবস্থার পরে চাইলে আনারস খেতে পারেন কিন্তু শরীরের অবস্থা বুঝে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ নিয়ে খেতে হবে। অনেকেই কাঁচা আনারস ব্যবহার করে থাকেন জুস বানানোর জন্য কিন্তু এটি দেহের জন্য ক্ষতিকর এবং খুব বিষাক্ত। এবং মাঝে মাঝে কাঁচা আনারস খাওয়ার কারণে বমির প্রবণতা দেখা দেয়।