তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে চারটি বিদেশি কোম্পানির প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকা গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহ চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে না অন্তর্বর্তী সরকার। কোম্পানিগুলো হচ্ছে- ভারতের এইচ এনার্জি, রাশিয়ার গ্যাজপ্রম, চীনের সিনোপ্যাক এবং উজবেকিস্তানের এরিয়েল।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনের আওতায় ছিল এ চুক্তিগুলো। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংক্রান্ত এ আইন বাতিল করায় এসব চুক্তি আর হচ্ছে না।
এ কর্মকর্তারা জানান, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০-এর অধীনে এসব বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির সম্ভাব্যতা যাচাই করে। কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব পর্যালোচনা, সম্ভাব্য ব্যয়ও চূড়ান্ত করা হয়েছিল। এ ছাড়া চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তুতিও চলছিল। কিন্তু চুক্তিগুলো স্বাক্ষরের আগেই গত ৫ আগস্ট গণ অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এখন থেকে মুক্ত প্রতিযোগিতা ছাড়া কিছুই হবে না। আমরা জ্বালানি অনুসন্ধানের জন্য উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করব। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে ২০১০ সালের আইনের আওতায় নেওয়া কোনো প্রকল্প অ্যাওয়ার্ড করা হবে না।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্রনাথ সরকার সম্প্রতি বলেন, বিশেষ আইনের আওতায় যে প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছে সেগুলো যাচাইবাছাইয়ের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার একটি কমিটি গঠন করেছে। সেখানে গ্যাজপ্রমের কূপ খননের কাজগুলোও যাচাই করা হবে। সেক্ষেত্রে কমিটি যে সিদ্ধান্ত নেবে তাই হবে। আমরা এক্ষেত্রে ওপেন টেন্ডারে চলে যাব। আমাদের দেশীয় উৎস থেকে দ্রুত গ্যাস আনতে হবে। সেক্ষেত্রে আমরা উন্মুক্ত টেন্ডারের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত আছি।
জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, গ্যাজপ্রমের সঙ্গে ভোলায় ৫টি গ্যাসকূপ খনন, এইচ এনার্জির সঙ্গে ভারত থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি এবং আমদানি করা এলএনজি সরবরাহে বাংলাদেশভিত্তিক কোম্পানি দীপন গ্যাসের সঙ্গে ভোমরা থেকে খুলনা পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণের চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত হয়েছিল। এ ছাড়া সিলেটে পাচটি গ্যাসকূপ খনন করার জন্য চীনের সিনোপ্যাক এবং ছয়টি কূপ খনন ও অন্যটিতে ওয়ার্কওভারের কাজ করার জন্য উজবেকিস্তানের এরিয়েলের সঙ্গে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের আলোচনা চলছিল।
জানা যায়, বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার নতুন কূপ খনন এবং বিদ্যমান কূপগুলোতে ওয়ার্কওভারের কাজ করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। এটি টেন্ডার প্রক্রিয়া ছাড়াই বিভিন্ন দেশি-বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা চালানো হচ্ছিল। এজন্য গ্যাজপ্রম, সিনোপ্যাক এবং এরিয়েলের সঙ্গে স্থলভাগে ১৭টি কূপে কাজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। জ্বালানি বিভাগ থেকে এর আর্থিক বিবরণ পর্যালোচনা করার পর প্রস্তাবগুলো তখন অনুমোদনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনে দেশে মোট ২০টি কূপ খনন করেছে গ্যাজপ্রম, যার মধ্যে ভোলার ৭টি কূপ ছিল। একই আইনের আওতায় নতুন করে ভোলায় বর্তমানে চারটি কূপ খননের কাজ করছে রাশিয়ান কোম্পানিটি। একই ফর্মুলায় ভোলার আরও ৫টি কূপ খননের কাজ তাদের দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। ভোলার ৫টি কূপ খননে গ্যাজপ্রমের দেওয়া প্রস্তাবের কারিগরি ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলো মূল্যায়ন শেষে জ্বালানি বিভাগে প্রতিবেদন দিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স)। এ প্রস্তাব নিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে বৈঠকও হয়েছে। এ ৫ কূপের মধ্যে একটি অনুসন্ধান কূপ, বাকিগুলো উন্নয়ন কূপ। এগুলো খননের জন্য রুশ কোম্পানিটি ১২০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় প্রস্তাব করেছে। সব শেষে এ ব্যয় নিয়ে জ্বালানি বিভাগ ও গ্যাজপ্রমের দরকষাকষি চলছিল।
ভারতের এইচ এনার্জি থেকে বছরে শূন্য দশমিক ৮ এমটিপিএ থেকে ১ এমটিপিএ (মিলিয়ন টন পার অ্যানাম) এলএনজি আমদানির জন্য চুক্তি করা হচ্ছিল। প্রায় চার বছর ধরে দুই পক্ষ আলোচনা করে বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেছিল। এ গ্যাস খুলনা ও দেশের পশ্চিমাঞ্চলে নির্মিত এবং নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে সরবরাহ করার পরিকল্পনা ছিল।
জ্বালানি বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, গত ২৭ জুলাই ভারতের এইচ এনার্জির সঙ্গে গ্যাস সরবরাহ চুক্তি (জিএসএ) বিষয়ে প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ কমিটির বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই সময় ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে বৈঠকটি আর হয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা জানান, ভারত থেকে এলএনজি আমদানির জন্য সাতক্ষীরা থেকে খুলনা পর্যন্ত ৬৫ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপনের বিষয়ে দীপন গ্যাস নামক একটি কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা চলছিল।
দীপন গ্যাস বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি। তবে ভারত ও সিঙ্গাপুরে এর কার্যক্রম রয়েছে বলে এর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে। ভারতের নুমালীগড় থেকে পাইপলাইনে যে জ্বালানি তেল বাংলাদেশ আমদানি করছে, সে পাইপলাইন স্থাপনের কাজ করেছে এ কোম্পানিটি। মহেশখালীতে এক্সিলারেট এনার্জির এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ ও একটি পাইপলাইন স্থাপনের কাজেও সম্পৃক্ত ছিল দীপন গ্যাস।
চীনা কোম্পানি সিনোপ্যাকের সঙ্গে সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের (এসজিএফসিএল) আওতাধীন ৫টি কূপ খনন নিয়ে আলোচনা চলছিল। কূপগুলো হলো- রশিদপুর-১১ ও ১৩, কৈলাশটিলা-৯ এবং সিলেটের ডুপি টিলা-১ আর একমাত্র উন্নয়ন কূপ সিলেট-১১। এসব প্রকল্পে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার মতো ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল।
এ ছাড়া উজবেক কোম্পানি এরিয়েলের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন জেলাজুড়ে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেডের অধীনে ৭টি কূপ খননের জন্য আলোচনা শেষ পর্যায়ে ছিল। জ্বালানি বিভাগ এ কূপগুলো খনন এবং সংস্কার করার জন্য এরিয়েলের প্রস্তাবের মূল্যায়ন শেষ করেছিল। প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে চারটি নতুন কূপ খনন করা এবং বিদ্যমান তিনটিতে ওয়ার্কওভার করা, যার ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছিল ১৩১ মিলিয়ন ডলার।