ভারতের উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়ার ৩২তম বার্ষিকী আজ শুক্রবার (৬ ডিসেম্বর)। ১৯৯২ সালের এই দিনে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা কয়েকশ বছর পুরোনো মসজিদটিতে হামলা চালিয়ে তা গুঁড়িয়ে দেয়।
যার জেরে ভারতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়, এতে দুই হাজারেরও বেশি লোক নিহত হন, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন মুসলিম।
সেই মসজিদটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর আদালতের মাধ্যমে সেখানে মন্দির বানানোর তোড়জোড় শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় এলে রাম মন্দির গড়ে তোলা হয়। গত জানুয়ারিতে ওই বিশাল মন্দির উদ্বোধন করেন মোদী।
বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির গড়ার মধ্য দিয়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে একটি হাতিয়ার তুলে দেওয়া হয়, যার ফলে তারা ভারতের বিভিন্ন স্থানের প্রাচীন মসজিদের নিচে মন্দির আছে দাবি করে আসছে। এর সবশেষ নজিরটি দেখা গেছে আজমীর শরিফের ক্ষেত্রে। দরগার নিচে মন্দির আছে দাবি করে এক পুরোহিত আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন, যা আমলে নিয়ে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে নোটিশ দিয়েছেন বিচারক।
এ ছাড়া সম্ভল, কাশী, মাথুরাসহ বিভিন্ন জায়গায় মসজিদের জায়গায় মন্দির ছিল দাবি করে সেখানেও জরিপের আবদার করেছে হিন্দুত্ববাদীরা। আদালতও সেসব আবদার মেনে আদেশ দিচ্ছে, যার জেরে সম্ভলে সংঘর্ষে কয়েকজন মুসলিম বিক্ষোভকারী প্রাণও হারিয়েছেন।
যেভাবে মসজিদ থেকে মন্দির
ইতিহাস বলছে, ১৫২৮ সালে প্রথম মুঘল সম্রাট বাবরের শাসনামলে সেনাপতি মীর বাকি বাবরি মসজিদ নির্মাণ করেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্য টিকে থাকে।
১৮৫৩ সালে হিন্দুত্ববাদী একটি গোষ্ঠী দাবি করে, বাবরের শাসনামলে মসজিদ নির্মাণের জন্য সেখানে মন্দির ভেঙে ফেলা হয়েছিল।
১৮৫৯ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশিক প্রশাসন মসজিদের স্থান হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য দুটি আলাদা অংশে ভাগ করে। মুসলিমদের ভেতরে নামাজ পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়, আর হিন্দুদের বাইরের আঙিনায় পূজা করার সুযোগ দেওয়া হয়।
ভারতের স্বাধীনতার পর ১৯৪৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর সরকার মসজিদটিকে ‘বিরোধপূর্ণ সম্পত্তি’ ঘোষণা করে এবং দরজায় তালা দেয়। পুলিশের দেওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী, হিন্দু পুরোহিতদের বিরুদ্ধে রামের মূর্তি মসজিদের ভেতরে স্থাপন করার অভিযোগ ওঠে। এরপরই সরকার এ পদক্ষেপ নেয়। সেই থেকে মুসলিমরা মসজিদে নামাজ পড়তে পারতেন না।
১৯৫০ সাল থেকে ৬১ সাল পর্যন্ত আদালতে চারটি দেওয়ানি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে ছিল মসজিদের স্থানের মালিকানা নিয়ে পাল্টাপাল্টি দাবি। এ ছাড়াও দুই ধর্মের অধিকারের দাবিও ছিল। হিন্দুদের পূজা-অর্চনা করার অধিকারও চাওয়া হয়েছিল।
মসজিদের জায়গায় মন্দির নির্মাণে নেতৃত্ব দিতে ১৯৮৪ সালে হিন্দুত্ববাদী কট্টরপন্থী কয়েকটি গোষ্ঠী একটি কমিটি গঠন করে। এসব গোষ্ঠীর মধ্যে বিশ্ব হিন্দু পরিষদও (ভিএইচপি) ছিল।
১৯৯০ সালে বিজেপি নেতা লাল কৃষ্ণ আদভানি মসজিদের স্থানে মন্দির নির্মাণের জন্য সারা দেশে একটি আন্দোলন শুরু করেন। এ আন্দোলন সহিংসতার রেশ রেখে যায়। পরে বিহারের পূর্বাঞ্চলে আদভানিকে গ্রেপ্তার করা হয়।
দিনটি ছিল ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। কয়েক হাজার হিন্দু জনতা মসজিদের চারদিকে জড়ো হয়। তারা মসজিদটি গুঁড়িয়ে দেয়। এরপর শুরু হয়ে যায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। মসজিদ ভেঙে ফেলার ১০ দিন পর ১৬ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় সরকার ওই ঘটনা তদন্ত করতে লিবারহান কমিশন গঠন করে।
মসজিদের ওই স্থানে হিন্দু মন্দির ছিল কি না, তা নির্ধারণে আদালতের নির্দেশে ২০০৩ সালে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা একটি সমীক্ষা শুরু করেন। সমীক্ষায় দাবি করা হয়, মসজিদের নিচে একটি মন্দিরের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তবে অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং মুসলমান সমীক্ষার ফল প্রত্যাখ্যান করেন।
মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়ার ১৭ বছর পর ২০০৯ সালে লিবারহান কমিশন প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনে বিজেপির কয়েকজন নেতা এবং তার আদর্শিক পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) নেতা মসজিদ ধ্বংসের জন্য দায়ী হিসেবে চিহ্নিত হন। আদভানিসহ বিজেপির কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা বিচারের মুখোমুখি হন।
২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে এলাহাবাদ হাইকোর্টের তিন বিচারক রায় দেন, মসজিদের জায়গা হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে ভাগ করতে হবে। আদালত রায়ে বলেন, ২ দশমিক ৭৭ একর (১ দশমিক ১২ হেক্টর) জমির দুই-তৃতীয়াংশ হিন্দু সম্প্রদায় নির্মোহী আখড়া এবং রাম লালা বিরাজমানের মালিকানায় যাবে, আর বাকি অংশ মুসলিম গোষ্ঠী (উত্তর প্রদেশের সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড) পাবে।
হিন্দু ও মুসলিম গোষ্ঠীগুলোর আপিলের পর ২০১১ সালের মে মাসে সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের দেওয়া রায় স্থগিত করে। ২০১৭ সালের মার্চে ভারতের প্রধান বিচারপতি আদালতের বাইরে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সমঝোতার প্রস্তাব দেন।
২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট মসজিদ ধ্বংসের মামলায় বিজেপি নেতা আদভানি, মুরলি মনোহর যোশী এবং আরও ১৩ জনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ পুনরুজ্জীবিত করে। একই বছরের ৫ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টে ১৩টি আপিলের শুনানি হয়।
২০১৯ সালের ২৫ জানুয়ারি ভারতের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ আগের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের তিনজন বিচারপতির বেঞ্চ গঠনের নির্দেশ বাতিল করে পাঁচজন বিচারকের বেঞ্চ গঠন করেন মামলার শুনানির জন্য।
পাঁচজনের নতুন ওই বেঞ্চে ছিলেন প্রধান বিচারপতি গগৈ এবং বিচারপতি এস এ বোবদে, ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়, অশোক ভুষাণ ও এস এ নাজির।
আদালতের বাইরে সমঝোতায় পৌঁছাতে ২০১৯ সালের ৮ মার্চ শীর্ষ আদালত একটি মধ্যস্থতাকারী প্যানেল গঠন করেন, যার নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এফ এম ইব্রাহিম কলিফুল্লা। পরে ২ আগস্ট মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় বলে জানিয়ে দেন সুপ্রিম কোর্ট।
অযোধ্যার সেই জমির বিরোধ নিয়ে ২০১৯ সালের ৬ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট প্রতিদিন শুনানির কথা জানান। পরে ১৬ অক্টোবর শুনানি শেষ হয়। পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ রায় ঘোষণা স্থগিত রাখেন। পরে ৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট কিছু শর্ত রেখে রায় দেন, মসজিদের ওই জমি একটি ট্রাস্টকে হস্তান্তর করা হবে, যেটি হিন্দু মন্দির নির্মাণের তদারকি করবে। আর অযোধ্যায় মুসলিম গোষ্ঠীগুলোর জন্য একটি আলাদা জমি বরাদ্দ করা হয়।
মন্দির নির্মাণ এবং পরিচালনার তদারকির জন্য ২০২০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ১৫ সদস্য বিশিষ্ট শ্রী রাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্ট গঠিত হয়। পরে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং ফলক উন্মোচন করেন।
২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর লক্ষ্ণৌর একটি আদালত প্রমাণের অভাবে মোদীর এক সময়ের বিশ্বস্ত সহযোগী আদভানিসহ বিজেপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের মুক্তি দেয়। নির্মাণকাজের কিছু অংশ অসম্পূর্ণ থাকা সত্ত্বেও ২০২৪ সালের ২২ জানুয়ারি মন্দিরের উদ্বোধন করা হয়।