এ এক আধুনিক বিশ্ব যা খুব পরিবর্তনশীল। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের এই ছোট দেশটাও অনেক পরিবর্তন হচ্ছে। আর এই পরিবর্তনের মূল নেয়ামক হিসেবে কাজ করছে নগরায়ন ,নগরায়ন এর ফলে দেশের উন্নয়ন সমৃদ্ধি হচ্ছে কিন্তু কমছে চাষের জমি।
নগরায়ন মানেই অনেক বড় বড় ইমারত। যার ফলে মানুষ হারাচ্ছে আবাদি চাষ যোগ্য জমি। তাই স্বাভাবিক ভাবেই কমছে কৃষি উৎপাদন। এমন সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে কৃষি উৎপাদন বাড়ানো। আর তাই নগরায়নের এই সময় ছাদ বাগান খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পরে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে। একই সাথে বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতেও এটি অবদান রাখবে। আর এই আধুনিকায়নের ফলে নগরায়ন সৃষ্টি হয়েছে ফলে কমেছে কৃষি জমি, বেড়েছে শহর। আর এই শহড়ে কিভাবে গড়ে তুলতে হবে শহুরে বাগান আজ সে বিষয় নিয়েই কথা বলবো।
ছাদ বাগান – ছাদ বাগান হচ্ছে বাড়ির ছাদে বা খালি জায়গায় বিভিন্ন উদ্যান ফসল বিশেষ করে ফুল, ফল, শাক-সবজির বাগান গড়ে তোলাকে বলা হয়। ছাদ বাগান একটি বাংলা শব্দ, এর ইংরেজী শব্দ ‘রুফ টপ গার্ডেন’ or roof gardening।
আধুনিক ছাদ বাগান বলতে কি বুঝি
বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে, সাজিয়ে গুছিয়ে কম জায়গায় অনেক কিছু চাষ করাকেই আধুনিক ছাদ বাগান বলে।
সাধারণ মাটিতে আর বাড়ির ছাদে গাছ লাগানো কিন্তু একই কথা নয়। ছাদে গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে নিতে হয় বাড়তি কিছু যত্ন। আপনি কী গাছ লাগাতে চাইছেন তার ওপর নির্ভর করছে কতটুকু জায়গায় কিভাবে লাগাবেন। বড় গাছ হলে গাছ লাগানোর পাত্রটিও বড় হতে হবে।
আধুনিক ছাদ বাগান
টবে গাছ লাগানোর সুবিধা হল খুব সহজে এগুলো স্থানান্তারিত করা যায়। সাধারণত যে আকারের টব বাসাবাড়িতে থাকে, তার থেকে বড় মাপের টবে গাছ লাগান। তাহলে ফলন ভালো হবে। এক্ষেত্রে সিমেন্টের তৈরি টব ব্যবহার করতে পারেন। ব্যবহার করতে হবে পর্যাপ্ত জৈব সার।
নগরায়নের যুগে আধুনিক ছাদ বাগানের গুরুত্ব
নগরায়নের কারনে চাষযোগ্য কৃষি জমি কমছে যা আমাদের সবার জানা। আর এর ফলে কৃষি উৎপাদন কমছে। যার কারনে বাজারে শাক সবজি ফল মূলের দাম বাড়ছে। আমরা যদি কোন ভাবে নিজের পরিবারের খাবারের পরিমান ফসল উৎপাদন করতে পারি তা হবে এই সময়ে দেশের এবং পরিবারের বড় উপকার। এই শহুরে জীবনে কি করে কৃষি বাগান করবেন!! উপায় একটাই তা হল আধুনিক ছাদ বাগান। ছাদ বাগান করলে –
💎 তাজা শাকসবজি ও ফল-ফুল পাওয়া যায়।
💎 বাড়তি আয় ও অবসর সময় কাটানো যায়।
💎 ছাদের সবুজ চত্বর ও বাগান বিনোদন দিতে পারে।
💎 পরিবেশ দুষণ মুক্ত রাখা যায়।
💎 জীব বৈচিত্র্য বা বায়ো ডাইভারসিটি সংরক্ষণে সহায়তা করতে পারে।
💎 অবকাঠামো তৈরিতে যে পরিমাণ চাষের জমি নষ্ট হয় ছাদে বাগানের মাধ্যমে তার কিছু অংশ পুষিয়ে নেওয়া যায়।
💎 ক্ষতিকর রাসায়নিক মুক্ত ফসল উৎপাদন করা যায়।
💎 বাড়ির পরিবেশ সুশীতল ও শান্তিময় থাকে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।
আধুনিক ছাদ বাগান কিভাবে শুরু করবেন
একটি আধুনিক ছাদ বাগান তৈরি করার জন্য আপনি নিম্নলিখিত ধাপগুলি অনুসরণ করতে পারেন:
ছাদের স্থান নির্বাচন করুন
আপনি যদি নতুন একটি ছাদ বাগান তৈরি করতে চান, তার জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করুন। ছাদের উপরে সূর্যের আলো আসতে পারে এবং মানুষের আনাগোনা কম থাকলে ভাল।
সুস্থ মাটি প্রদান করুন
একটি ভাল ছাদ বাগান তৈরি করতে হলে সুস্থ এবং পুষ্টিকর মাটি প্রদান করতে হবে। পুষ্টিকর মাটির কারণে গাছ ভাল উষ্ণতা, পুষ্টি এবং প্রসার পায়।
ছাদ বাগানের ডিজাইন করুন
আপনি কি ধরনের ছাদ বাগান তৈরি করতে চান তা নির্ধারণ করুন। উদাহরন হতে পারে, মাচা দিয়ে অথবা টব বা দু’টাই নিতে পারেন।
ছাদের বৈশিষ্ট
ছাদের উপর ভারী ওজন ধারণ করতে সক্ষম হতে হবে, তা নিশ্চিত হতে হবে।
জল সংগ্রহ করুন
ছাদ বাগানে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে রাখতে পারলে ভাল হবে। এটি খুব সহায়ক হবে বাগানের জন্য।
সুরক্ষা প্রদান করুন
একটি আধুনিক ছাদ বাগান তৈরি করতে আপনার ছাদটির ভাল মানের সুরক্ষা ব্যবস্থা রাখতে হবে।
এই ধাপগুলি অনুসরণ করে আপনি একটি আধুনিক এবং আকর্ষণীয় ছাদ বাগান তৈরি করতে পারেন।
আধুনিক ছাদ বাগানের প্রয়োজনীয় উপকরণ
💎 একটি খালি খোলা ছাদ।
💎গাছের চারা, কলম বা বীজ।
💎 হাফ ড্রাম, সিমেন্ট বা মাটির টব, ষ্টিল বা প্লাস্টিক ট্রে।
💎 ছাদের সুবিধা মত স্থানে স্থায়ী বেড ।
💎 সিকেচার, কোদাল, কাচি, ঝরনা, বালতি, করাত, খুরপি, স্প্রে মেশিন ইত্যাদি।
দোঁআশ মাটি, পঁচা শুকনো গোবর ও কম্পোস্ট
দোঁআশ মাটি, পঁচা শুকনো গোবর
💎 দোঁআশ মাটি, পঁচা শুকনো গোবর ও কম্পোস্ট, বালু ও ইটের খোয়া ইত্যাদি।
💎 পানি দেয়ার ব্যবস্থা।
আধুনিক ছাদ বাগানের ফসল
ছাদে বাগান করার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন গাছটি বড় আকারের না হয়। অর্থাৎ ছোট আকারের গাছ লাগাতে হবে এবং ছোট আকারের গাছে যেন বেশি ফল ধরে সে জন্য হাইব্রিড জাতের ফলজ গাছ লাগানো যেতে পারে।
সবজি: টমেটো, বেগুন, ফুলকপি, ব্রোকলি, লাউ, করলা,মিষ্টিকুমড়া, সীম, কলমীশাক, বরবটি, ডাঁটা, লালশাক, পুঁইশাক, মুলা ইত্যাদি।
ফল: লেবু, পেয়ারা, আম, ডালিম, স্ট্রবেরি, বাউকুল, আপেলকুল ইত্যাদি।
ফুল: গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা, বেলী, ডালিয়া, রজনীগন্ধা, মৌসুমী ফুল ইত্যাদি।
মসলা: মরিচ, ধনেপাতা, পুদিনা ইত্যাদি।
আধুনিক ছাদ বাগানের পরির্চযা
বালাই দমনে পরিবেশ বান্ধব আইপিএম পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার না করে জৈব রাসায়নিক বালাইনাশক যেমন- নিমবিসিডিন, বাইকাও-১ ব্যবহার করা যেতে পারে।টবের ক্ষেত্রে ছোট গাছ, বড় হলে পট/টব বদল, রিপটিং (পুরানো টবকে আলতো করে মাটিতে শুইয়ে গড়াগড়ি দিলে গাছটি টব থেকে বেড়িয়ে আসবে। পরে অতিরিক্ত মূল কেটে মাটি বদলিয়ে সার প্রয়োগসহ নতুনভাবে গাছ বসানো) করতে হবে সময়মতো। বছরে অন্তত একবার পুরাতন মাটি বদলিয়ে নতুন মাটি জৈব সারসহ দিতে হবে। ইদানিং বাজারে টবের মাটি কিনতে পাওয়া যায়। মানসম্মত মাটি কিনে টবে/পটে/ড্রামে ভরতে হবে।
খুব সাবধানতার সাথে টব/পটে/ড্রামে/চারা/কলম/বীজ লাগাতে হবে। ঠিক মাঝখানে পরিমাণ মতো মাটির নিচে রোপন করতে হবে। চারা বা কলমের সাথে লাগানো মাটির বল যেন না ভাঙ্গে সেদিকে নজর রাখতে হবে। চারা বা কলমের ক্ষেত্রে বীজতলা/নার্সারিতে যতটুকু নিচে বা মাটির সমানে ছিল ততটুকু সমানে ছাদে লাগাতে হবে। বীজতলার থেকে বেশি বা কম গভীরে লাগালে গাছের বৃদ্ধিতে সমস্যা হবে। মাঠে ফলমুল সবজি চাষের চেয়ে ছাদে সবজি চাষের অনেক পার্থক্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা। ছাদের বাগানে প্রতিদিন পরিষ্কার কার্যক্রম অনুসরণ করতে হবে। সেজন্য পুরাতন রোগাক্রান্ত, বয়স্ক ডালপালা, পাতা সাবধানতার সাথে কেটে নির্দিষ্ট স্থানে জমা করতে হবে। এতে গাছপালা রোগমুক্ত থাকবে ফলনে সুবিধা হবে। ফুল এবং সবজিতে প্রয়োজন মাফিক জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু ফলের ক্ষেত্রে অন্তত দু’বার -একবার বর্ষার আগে একবার বর্ষার পরে সাবধানে পরিমাণমত সার দিতে হবে। সার প্রয়োগের সময় মাটির আর্দ্রতা দেখে নিতে হবে। কেননা বেশি আর্দ্র বা কম আর্দ্র কোন টাইপের সার প্রয়োগের জন্য উপযুক্ত নয়। বিশেষ ক্ষেত্রে কিছু কিছু সার পানিতে মিশিয়ে গাছ ছিটিয়ে দিতে হবে। গুঁটি সারও এ ক্ষেত্রে বিশেষ উপযোগী।
আমাদের দেশের আবহাওয়ায় ফলে পোকা বা রোগের আক্রমণ অহরহ ঘটে থাকে। সেক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। প্রতি সপ্তাহে ২/৩ বার যদি ছাদের বাগান পরিদর্শন করা যায় তাহলে বালাই আক্রমণ যেমন কম হবে তেমনি ফসলও পাওয়া যাবে অনেক। সুতরাং লাভ বেশি হবে। যদি হঠাৎ বেশি মারাত্মক ভাবে আক্রান্ত হয়ে যায় তখন উপযুক্ত বালাইনাশক সঠিক সময়ে ব্যবহার করতে হবে। আলোচ্য নিবন্ধে ছাদের কথা বলা হয়েছে কিন্তু অন্যান্য পদ্ধতি অনুসরন করে স্থানকালপাত্র অনুযায়ী ঘরের ভেতরে, সিঁড়ি, ব্যালকনি, বারান্দা, কার্নিশ এসব জায়গায়ও অনায়াসে গাছ লাগানো যায়।
আধুনিক ছাদ বাগানের গুরুত্তপূর্ণ টিপস
💎 হাফ ড্রাম এর তলদেশে অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের জন্য ১ ইঞ্চি ব্যাসের ৫ থেকে ৬ টি ছিদ্র রাখতে হবে।
💎 ছিদ্রগুলোর উপর মাটির টবের ভাঙ্গা টুকরো দিতে হবে।
💎 ড্রামের তলদেশে ১ ইঞ্চি পরিমান ইটের খোয়া বিছিয়ে তার উপর বালি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
💎 সমপরিমান দোঁআশ মাটি ও পচা শুকনো গোবরের মিশ্রণ দিয়ে ড্রামটির দুই তৃতীয়াংশ ভরার পর প্রতি হাফ ড্রামে মিশ্র সার আনুমানিক ৫০ থেকে ১০০ গ্রাম প্রয়োগ করে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে এবং সম্পূর্ণ ড্রামটি মাটি দিয়ে ভর্তি করে নিতে হবে।
💎 ১৫ দিন পর ড্রামের ঠিক মাঝে মাটির বল পরিমান গর্ত করে নির্বাচিত গাছটি রোপণ করতে হবে। এ সময় চারা গাছটির অতিরিক্ত শিকড় বা মরা শিকড়সমূহ কেটে ফেলতে হবে এবং খেয়াল রাখতে হবে মাটির বলটি যেন কোনোভাবেই ভেঙ্গে না যায়।
আধুনিক ছাদ বাগানের গুরুত্তপূর্ণ
💎 রোপিত গাছটি খুটি দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। যাতে বাতাসে ভেঙ্গে বা হেলে না পরে।
💎 রোপণের পর গাছের গোড়া ভালভাবে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে।
💎 সময়ে সময়ে প্রয়োজন মত গাছে পানি সেচ ও উপরি সার প্রয়োগ, বালাই দমন ব্যবস্থা নিতে হবে।
💎 রোপণের সময় প্রতিটি হাফ ড্রামে ৪-৬ টি সিলভামিক্স ট্যাবলেট সার গাছের গোড়া থেকে ১৫ সেন্টিমিটার দুর দিয়ে মাটির ১০ সেন্টিমিটার গভীরে প্রয়োগ করতে হবে। এটি গাছকে তার দরকারি পুষ্টি উপাদানগুলো ধীর গতিতে সরবরাহ করে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
💎 এ ছাড়া লতানো গাছের জন্য বাউনি/জাংলা/মাচা দিতে হবে। ছাদ বাগানের আগাছা দমন করতে হবে নিয়মিত। সেচের পর মাটিতে চটা বাঁধলে মালচিং করে দিতে হবে। অপ্রয়োজনীয় বয়স্ক, মরা শাখা অপসারণ করতে হবে। প্রয়োজনে ফল ধারণ বৃদ্ধির জন্য হাতে পরাগায়ন করা যেতে পারে।
আধুনিক ছাদ বাগানের সব থেকে বড় উপকার হচ্ছে, নিজের এবং নিজের পরিবারের মন এবং শারীরিক সুস্থতা। সবুজ সব সয়ময় আপনার মন ভাল রাখবে আর বাগান করতে যে পরিশ্রম হবে তা আপনার ব্যায়ামের কাজ করবে।
https://bangla-bnb.saturnwp.link/used-smartphone/
পরিশেষে বলা যায়, একটি আধুনিক ছাদ বাগান নিজের পরিবার, সমাজ, পরিবেশ এবং অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আসুন সবাই নিজেদের ফাকা ছাদে একটা আধুনিক ছাদ বাগান গড়ে তুলি।