টাঙ্গাইলের মধুপুরের ঐতিহ্যবাহী আনারস স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয় ও একটি এলাকার চিহ্নিত পণ্য হওয়ায় আনারসকে জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন (জিআই) বা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মুনিম হাসান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপন জারি হয়। জেলা প্রশাসক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৩১ নম্বর শ্রেণিতে পণ্যটি জিআই-৫২ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। মধুপুরের স্বাদের আনারস জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেয়ে খুশি চাষিরা ও জেলাবাসী।
জানা যায়, আনারসের রাজধানী হিসেবে খ্যাত মধুপুর গড়াঞ্চল। বাংলাদেশে সর্ব প্রথম আনারস চাষের গোড়াপত্তন হয় ১৯৪২ সালে। মধুপুরের ইদিলপুর গ্রামের ক্ষুদ্র-নৃতাত্ত্বিক গারো সম্প্রদায়ের লোকজন প্রথম আনারস চাষ করেন। মেঘালয় থেকে ৭৫০টি চারা এনে চাষ শুরু করেন। ওই চাষকে সমৃদ্ধ করে বতর্মানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আনারস চাষ হয়। শত বছরের ঐতিহ্য-ইতিহাসের সাথে মিশে আছে সুস্বাদু এ আনারস।
মধুপুরের জলছত্র বাজারটি আনারসের বিখ্যাত হাট। প্রতিদিন কোটি টাকার বেচাকেনা হয় থাকে এখানে। দেশের বিভিন্ন স্থানের পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা আনারস কিনে নিয়ে যান। আকার ভেদে ২০ থেকে ৬০ টাকা ধরে প্রতিটি আনারস বিক্রি হয়। আনারস চাষে উদ্বুদ্ধ করতে কৃষি বিভাগের নানামুখী উদ্যোগে প্রতিনিয়তই বাড়ছে চাষির সংখ্যা। মধুপুর থেকে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় ঢাকা, কুষ্টিয়া, বগুড়া, সিলেট, নাটোর, রাজশাহী, খুলনা, হবিগঞ্জ, নীলফামারী, গাইবান্ধা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নারায়নগঞ্জ ও দিনাজপুরসহ সারাদেশে আনারস সরবরাহ করা হয়ে থাকে।
দেখা যায়, মধুপুরের জলছত্র বাজারে সারিবদ্ধভাবে আনারস সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আনারস চাষিরা কেউ ভ্যানে করে, কেউবা সাইকেল আবার কেউবা ট্রাক ও পিকআপ ভর্তি আনারস নিয়ে বসে আছেন। পাইকাররা তাদের কাছ থেকে আনারস ক্রয় করে নির্দিষ্ট স্থানে জড়ো করছেন। পরে তা ট্রাকভর্তি করে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন। অপরদিকে খুচরা ব্যবসায়ীরা আনারস ক্রয় করে অটোরিকশা ও ছোট পিকআপযোগে যার যার গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছেন।
নরসিংন্দি থেকে আনারস কিনতে আসা পাইকার ব্যবসায়ী আলামিন মিয়া বলেন, মধুপুরের জলছত্র বাজারে আনারসের পাইকারি হাট হয়। সেজন্য আনারস কিনতে এসেছি। এখানকার আনারস সারা দেশেই পরিচিত খেতেও সুস্বাদু। এখান থেকে ৬০০ পিস আনারস নিয়েছি ১০-১১ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আশা করি ভালো দাম বিক্রি করতে পারবো।
আনারস চাষি রাশেদ খান বলেন, আমি ৬ বিঘা জমিতে আনারস চাষ করেছি। এতে তিন লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। বর্তমান যে বাজার আছে এরকম থাকে খরচ বাদ দিয়ে এক থেকে দেড় লাখ টাকা লাভ থাকবে। আমাদের মধুপুরের আনারস জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে। এতে আমরা অনেক আনন্দিত।
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত মধুপুরের কৃষক ছানোয়ার হোসেন বলেন, মধুপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য আমাদের আনারস। জিআই পণ্য হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ায় আমরা গর্বিত আনন্দিত ও উদ্বেলিত। বিশ্ব মানচিত্রে এই আনারসের কল্যাণে মধুপুর উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে টিকে থাকবে।
আজিজ চাষা বলেন, আমাদের মধুপুরের আনারসের সুনাম সারাদেশেই আছে। এখানকার আনারস খেতে খুবই স্বাদ ও রসালু। দুদিন আগে আমাদের আনারস জিআই পণ্য হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এতে আমরা গর্বিত ও আনন্দিত।
মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাকুরা নাম্নী বলেন, চলতি বছর জেলায় ৭ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে আনারসের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে মধুপুর উপজেলায় ৬ হাজার ৬৩০ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে। গত বছর জেলায় ৭ হাজার ৬৬১ হেক্টর জমিতে আনারস চাষ হয়েছে। ২ লাখ ৮২ হাজার টন আনারস উৎপাদিত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, জায়ান্টকিউ (ক্যালেন্ডার), হানিকুইন (জলডুবি) ও এম-ডি-টু জাতের আনারস চাষ হয়ে থাকে। আনারস থেকে উদ্যোক্তাদের জ্যাম, জেলি, জুস ও আচার উৎপাদনের পরামর্শ দেওয়া হয়। বিদেশেও রপ্তানির পরিকল্পনা রয়েছে।
টাঙ্গাইলের নবাগত জেলা প্রশাসক শরীফা হক বলেন, রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই জেলা টাঙ্গাইল। জেলাটি ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি ও চমচমের পর এবার মধুপুরের আনারস জিআই পণ্য স্বীকৃতি পেল। এতে আমরা আনন্দিত, সেইসাথে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। জিআই পাওয়ায় এর বিশ্বব্যাপী ব্রান্ডিং এবং বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ আরও বিস্তৃত হবে। জিআই এর সুফল পেতে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করবো। টাঙ্গাইলের আরও কয়েকটি পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেতে আবেদন করা হয়েছে।