অর্থসম্পদ মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ জন্যই মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ফরজ ইবাদত আদায়ের পর জীবিকার সন্ধানে জমিনে ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর যখন সালাত সমাপ্ত হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় আর আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে অনুসন্ধান কর এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফল হতে পার।’ (সুরা জুমা, আয়াত : ১০)
জীবনের তাগিদে মানুষকে জীবিকা উপার্জন করতে হবে। তবে তার পদ্ধতি হবে কোরআন-হাদিসের নির্দেশিত পদ্ধতি। কেননা হালাল উপার্জন ও হালাল ভক্ষণ প্রতিটি মুসলমানের ওপর ফরজ। মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘হে মুমিনরা, আহার করো আমি তোমাদের যে হালাল রিজিক দিয়েছি তা থেকে এবং আল্লাহর জন্য শোকর করো, যদি তোমরা তাঁরই ইবাদাত করো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৭২)
এর বিপরীতে অবৈধ উপার্জনকে হারাম করেছেন। অবৈধ পন্থায় বাহ্যিক ভাবে ওপরে ওঠা সহজ হলেও এর বহু অপকারিতা রয়েছে। যা তীলে তীলে মানুষকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। মানুষের ইহকাল-পরকালকে কলুষিত করে দেয়। দুনিয়া ও আখিরাতে বহুবিধ শাস্তির মুখোমুখী করে। নিম্নে হারাম উপার্জনের কিছু কুফল তুলে ধরা হলো—
আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত
হারাম উপার্জনের সবচেয়ে বড় ক্ষতিকারক দিক হলো, তা মানুষকে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত করে। দুনিয়ার মোহ তাদের আখিরাতের সফলতা থেকে বঞ্চিত করে। মহান আল্লাহ হারাম উপার্জনকারীর ওপর এতটাই ক্রোধান্বিত হবেন যে, কিয়ামতের তাদের দিকে তিনি তাকাবেন না। তার চেয়ে বড় হতভাগা আর কে হতে পারে, কিয়ামতের দিন যার ওপর আল্লাহ অসন্তুষ্ট থাকবেন এবং তাকে পরিশুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকবেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর সঙ্গে করা প্রতিশ্রুতি এবং নিজেদের শপথের বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য খরিদ করে, আখেরাতে তাদের কোনো অংশ নেই। আর আল্লাহ তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না এবং তাদের দিকে তাকাবেন না কেয়ামতের দিন। আর তাদের পরিশুদ্ধও করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে মর্মম্ভদ শাস্তি।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৭৭)
রাসুল (সা.)-এর অভিশাপ
হারাম উপায়ে অর্থ উপার্জনের অন্যতম রাস্তা হলো সুদ-ঘুষ, যারা সুদভিত্তিক লেনদেনে লিপ্ত, রাসুল (সা.) তাদের অভিশাপ দিয়েছেন। জাবের (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) সুদখোর, সুদদাতা, সুদের লেখক ও তার সাক্ষীদ্বয়ের ওপর অভিসম্পাত করেছেন এবং বলেছেন—এরা সবাই সমান অপরাধী। (মুসলিম, হাদিস : ৩৯৮৫)
অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ঘুষদাতা ও গ্রহীতার ওপর আল্লাহর অভিশাপ।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৩১৩)
দোয়া কবুল হয় না
যারা হারাম পন্থায় উপার্জন করে, মহান আল্লাহ তাদের দোয়া কবুল করেন না। রাসুলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন : দীর্ঘ সফরের ক্লান্তিতে যার মাথার চুল বিক্ষিপ্ত, অবিন্যস্ত ও সারা শরীর ধুলিমলিন। সে আকাশের দিকে হাত তুলে বলে, হে আমার প্রভু! হে আমার প্রতিপালক! অথচ তার খাদ্য ও পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম, তার জীবন-জীবিকাও হারাম। এমতাবস্থায় তার দোয়া কিভাবে কবুল হতে পারে? (তিরমিজি, হাদিস : ২৯৮৯)
বরকত উঠে যায়
হারাম উপার্জনে মানুষের রিজিক থেকে বরকত উঠে যায়। ফলে সে বহু পরিশ্রম ও উপার্জন করেও যাবতীয় কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়। তার হাঁড়ভাঙা পরিশ্রম ও উপার্জিত সম্পদ দুনিয়া-আখিরাতে তার জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না। অশান্তি ও ব্যর্থতা তার নিত্যদিনে র সঙ্গী হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন আর দান-সদকা বাড়িয়ে দেন।’ (সুরা: বাকারা, আয়াত : ২৭৬)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরবিদরা বলেন, যে সম্পদের সঙ্গে সুদ মিশ্রিত হয়ে যায়, বেশির ভাগ সময় সেগুলো ধ্বংস হয়, অধিকন্তু আগে যা ছিল, তাও সঙ্গে নিয়ে যায়। সুদ ও জুয়ার ক্ষেত্রে দেখা যায়, অজস্র পুঁজির মালিক কোটিপতি দেখতে দেখতে দেউলিয়া ও ফকিরে পরিণত হয়। এভাবে হারাম উপার্জন মানুষের রিজিক কমিয়ে দেয়।
দান-সদকা কবুল হয় না
দান-সদকা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম মাধ্যম, কিন্তু হারাম উপার্জনের দান মানুষের কোনো কাজে আসে না। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা পবিত্রতা ছাড়া কোনো সালাত কবুল করেন না এবং অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদের সদকা গ্রহণ করেন না।’ (নাসায়ি, হাদিস : ১৩৯)
কবরের শাস্তি
হারাম উপার্জন মানুষকে যেভাবে দুনিয়াতে শাস্তি দেয়, তেমনি কবরেও তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি। সামুরাহ ইবনে জুনদুব (রা.) বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, আজ রাতে আমি স্বপ্নে দেখেছি, দুই ব্যক্তি আমার কাছে আগমন করে আমাকে এক পবিত্র ভূমিতে নিয়ে গেল। আমরা চলতে চলতে এক রক্তের নদীর কাছে পৌঁছলাম। নদীর মধ্যস্থলে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে এবং আরেক ব্যক্তি নদীর তীরে, তার সামনে পাথর পড়ে রয়েছে। নদীর মাঝখানের লোকটি যখন বের হয়ে আসতে চায় তখন তীরের লোকটি তার মুখে পাথর খণ্ড নিক্ষেপ করে তাকে স্বস্থানে ফিরিয়ে দিচ্ছে। এভাবে যতবার সে বেরিয়ে আসতে চায় ততবারই তার মুখে পাথর নিক্ষেপ করছে আর সে স্বস্থানে ফিরে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ ব্যক্তি কে? সে বলল, যাকে আপনি (রক্তের) নদীতে দেখেছেন, সে হলো সুদখোর। (বুখারি, হাদিস : ২০৮৫)
আখিরাতের শাস্তি
আখিরাতেও অবৈধ উপার্জনকারী কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে। খাওলা আনসারিয়া (রা.) বলেন, ‘আমি নবী (সা.)-কে বলতে শুনেছি, কিছু লোক আল্লাহর দেওয়া সম্পদ অন্যায়ভাবে ব্যয় করে, কিয়ামতের দিন তাদের জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত।’ (বুখারি, হাদিস : ৩১১৮)
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে হারাম থেকে দূরে থাকার তাওফিক দান করুন।