জ্বালানি সংকট ও বকেয়া বিল পরিশোধ করতে না পারায় দেশের বড় ছয়টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন কোনোটি আংশিক ও কোনোটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। গ্রামাঞ্চলে অনেক এলাকায় এরই মধ্যে শীত অনুভূত হওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা কমেছে। কিন্তু একসঙ্গে বড় কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন কমে যাওয়ায় এবং কয়েকটি পুরোপুরি বন্ধ থাকায় গত তিন দিনে দেশব্যাপী ৭০০ থেকে সর্বোচ্চ ১৬০০ মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং হয়। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বলা হচ্ছে, জ্বালানি সংকটের বিষয়টি দ্রুত সমাধান করা যাবে এমন আশা করা যাচ্ছে না। তবে সামনে যেহেতু শীত মৌসুম এসে যাচ্ছে তখন বিদ্যুতের চাহিদা কমে যাবে। সে সময় বেজ পাওয়ার স্টেশনগুলো জাতীয় গ্রিডের লোড সামলাতে পারবে। ফলে শীতের (নভেম্বর-ডিসেম্বর-জানুয়ারি) তিন মাস গ্রাহকরা স্বস্তিতে থাকতে পারবেন। এর মধ্যে ডলার ও জ্বালানি সংকটও কেটে যেতে পারে বলে বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য বলছে, জ্বালানি সংকটের কারণে দেশের তিনটি বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র এখন কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে না। এর মধ্যে আছে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ইউনিক মেঘনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং সামিটের মেঘনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এ ছাড়া আদানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র গতকাল বাংলাদেশে ৭৩১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ৩৬৬ মেগাওয়াট এবং এস এস পাওয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র ৩৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করে।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাস ও কয়লা সংকটের কারণে দেশের বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। আর ভারতের আদানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বকেয়া বিল পরিশোধ করতে না পারায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। গ্যাস সংকটের কারণে গ্যাসভিত্তিক দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এখন কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে না। আর কয়লা সংকটের কারণে এবং বিল বকেয়া পড়ায় কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন কমে গেছে এবং বন্ধ আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট কিন্তু কয়লা সংকটে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি এখন পুরোপুরি বন্ধ আছে। কয়লা সংকটের কারণে গত ২৫ অক্টোবর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এতে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেকটাই কমেছে। এ কারণে দেশব্যাপী গত ৩-৪ দিন ধরে লোডশেডিং হচ্ছে। এর প্রভাব বেশি পড়ছে গ্রামাঞ্চলে।
ভারতের ঝাড়খে র আদানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি গত ২৮ অক্টোবর পিডিবিকে এক চিঠি দেয়। এতে আদানি কর্তৃপক্ষ গত ৩০ অক্টোবরের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারকে বিদ্যুতের বকেয়া বিল পরিশোধ করতে বলে। তা না হলে ক্রয়চুক্তি অনুযায়ী ৩১ অক্টোবর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করতে তারা বাধ্য হবে বলেও জানান। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদন সক্ষমতা ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। বকেয়া বিল বাড়তে থাকায় তারা এরই মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। গত ৩১ অক্টোবর থেকে তারা বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিতে শুরু করে। গতকাল সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাংলাদেশে ৭৩১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। এ বিষয়ে আদানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বকেয়া বিলের কারণেই আদানি কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে।’ আর বিদ্যুৎ বিভাগ ও আদানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র সূত্র বলছে, প্রতি সপ্তাহে আদানির বিল পাওনা হচ্ছে ২ কোটি ২০ লাখ থেকে আড়াই কোটি ডলার। এর বিপরীতে পিডিবি তাদের পরিশোধ করছে ১ কোটি ৮০ লাখ ডলারের মতো। এতে অক্টোবর পর্যন্ত আদানির পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৫ কোটি ডলার।
এ ছাড়াও দেশের অন্যতম বড় আরেকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র রামপাল। এই কেন্দ্রের সক্ষমতা ১৩২০ মেগাওয়াট। কয়লা সংকটের কারণে রামপাল গতকাল উৎপাদন করে মাত্র ৩৬৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। অর্থাৎ এর একটি ইউনিট বন্ধ আছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের এস এস পাওয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সক্ষমতা ১৩২০ মেগাওয়াট। কিন্তু কয়লা সংকটে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রেরও একটি ইউনিট এখন বন্ধ আছে। গতকাল এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৩৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়।
গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ৫৮৪ মেগাওয়াট ইউনিক মেঘনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্র পুরোপুরি বন্ধ। এ ছাড়া ৫৮৩ মেগাওয়াটের গ্যাসভিত্তিক সামিট মেঘনাঘাট-২ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ আছে। এ ছাড়া গ্যাস ও জ্বালানি সংকটে দেশের আরও বেশ কয়েকটি গ্যাসভিত্তিক ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পুরোপুরি বা আংশিক বন্ধ আছে।