মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা মির্জা জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবর ঐতিহাসিক পানিপথের যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদিকে পরাস্ত করে মোগল সাম্রাজ্য গড়লেও আগের রাজকীয় রাঁধুনিদের তিনি বরখাস্ত করেননি। এক রাঁধুনি বিশ্বাসঘাতকতা করে খরগোশের ঝোল, জাফরানযুক্ত গোশত, চাপাতি বা রুটির মধ্যে বিষ মিশিয়ে দেয়। খাদ্য গ্রহণের পর অসম্ভব বমি হয় বাবরের। সে যাত্রা বেঁচে গেলেও মাত্র ৪৭ বছর বয়সে মারা যান প্রথম মোগল সম্রাট বাবর (১৪৮৩-১৫৩০ খ্রি.)।
তাই শেরশাহ কর্তৃক বিতাড়িত সম্রাট হুমায়ুন রাজ্য উদ্ধারে পারস্য অঞ্চলের রাঁধুনি নিয়ে আসেন ভারতে। মোগলদের খাবার তাদের অভিজাত রন্ধনশৈলীর কারণে হতো তৃপ্তিদায়ক ও হৃদয়গ্রাহী। যেমন—নিরামিষের মধ্যে ‘জর্দা বিরিঞ্জ’ নামের একটি ব্যঞ্জনের উল্লেখ আছে ‘আইন-ই-আকবরি’তে, এ পদটি ১০ সের সুগন্ধি চাল, ৫ সের মিছরি, ৪ সের ঘি, আধাসের কিশমিশ, কাজু, পেস্তা দ্বারা তৈরি হতো।
নানা রকম সবজির ব্যঞ্জনও তৈরি করা হতো। মোগল বাবুর্চিদের ইরানি ও স্থানীয় রন্ধনশৈলীর সমন্বয়ে নতুন পদ্ধতির মোগলাই খাবারের প্রচলন। সম্রাট শাহজাহান ১৪০ প্রকার পানীয় রাখতেন। থাকত ৬০ থেকে ১০০টি পদের খাবার। শেষ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহর খাবারে ৮০ থেকে ৯০ পদ রাখা হতো। সম্রাট আকবর রাতে জেগে উঠে ১০৩ রকমের ডালের সঙ্গে টাটকা ফুলকো লুচি ও কোয়েলের মাংস চাইতেন। আকবরের জন্য এক কড়াই ঘিয়ে একটা পরোটা ভাজা হতো। দ্বিতীয়টির জন্য আরেক কড়াই। সম্রাট হুমায়ুনের যুদ্ধবন্দিদের নাশতায় আপ্যায়নে ২৫০ রকমের খাবার ছিল।
সম্রাট শাহজাহান খাবার খেতেন সুলাইমানি বা আকিক পাথরের তৈরি প্লেটে। এ পাথরের প্লেটে রাখা খাবারে বিষ থাকলে তার রং পাল্টে যায়। মোগলদের রসনাবিলাসের তালিকায় আছে বিরিয়ানি, পোলাও, কোরমা, কাবাব-কোফতা, ফালুদা, সমুচা, হালিম, জিলাপি ইত্যাদি।
মোগলদের রসনাবিলাস বাঙালি মুসলিম খাবারে এনেছে ভোজন রসিকতার তকমা! তবে বুঝতেই হবে এবং মনে রাখা জরুরি : ‘এক দিন খেলে কিছু হয় না’ কথাটি সম্পূর্ণ ভুল ও অবৈজ্ঞানিক। অপরিমিত ও অপরিকল্পিত খাদ্য গ্রহণের পথ ধরেই আসে অ্যাজমা, ব্লাড প্রেসার, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস বা A B C D আদ্যক্ষরের ঘাতক ব্যাধি। ক্ষেত্রভেদে মেদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মেধা কমতে থাকে।
পুষ্টিবিজ্ঞানীরা স্থূলতা হ্রাসের জন্য ১০০ শতাংশ ইচ্ছাশক্তি, ধৈর্য, খাদ্যতালিকা, খাদ্য পরিকল্পনা, ব্যায়াম বা হাঁটাহাঁটির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেন। কেননা এটাই ইসলামের শিক্ষা। অসংখ্য হাদিসে প্রমাণ রয়েছে প্রিয় নবী (সা.) দৌড়ানো, তীর নিক্ষেপ, শারীরিক কসরত, ঘৌড়দৌড় ইত্যাদি প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করতেন। মহান আল্লাহর শাহি দরবারে প্রিয় নবী (সা.)-এর মোনাজাত ‘হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে সুস্বাস্থ্য কামনা করি…।’ (বায়হাকি)
সঠিক খাদ্য-পুষ্টি ব্যবস্থাপনা ও সুস্বাস্থ্য পরস্পর পরিপূরক। অথচ আমরা কয়জনই বা মেনে চলি তা? প্রিয় নবী (স.) সব সময় স্বল্প পরিমাণ সাধারণ খাদ্য গ্রহণ করতেন। অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস নবীজির অপছন্দ ছিল। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘মহানবী (সা.)-এর ওফাত পর্যন্ত তাঁর পরিবারবর্গ একাদিক্রমে দুদিন পেটভরে যবের রুটি খাননি।’ (শামায়েলে তিরমিজি) নোমান (রা.) বলেন, ‘তাঁর কাছে সাধারণ খেজুরও এতটা থাকত না, যাতে তিনি পেটভরে খেতে পারতেন।’ (শামায়েলে তিরমিজি)
অতিভোজন স্থূলতার কারণ। প্রিয় নবী (সা.) মুমিন ও কাফিরের মনস্তুষ্টিগত পার্থক্য বোঝাতে বলেন, ‘মুমিন খায় এক পাকস্থলীতে আর কাফির খায় সাত পাকস্থলীতে…।’ (বুখারি) অতিভোজনে খাদ্য অপচয় হয়। এ জন্যই প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা তোমাদের খাদ্যদ্রব্য মেপে নাও, এতে তোমাদের বরকত দেওয়া হবে।’ (বুখারি)
পরিশেষে মানুষ খাওয়ার জন্য বাঁচে না, বরং বাঁচার জন্যই খায়। বুঝতে হবে মানুষ না খেয়ে মরে না, বরং বেশি খেয়ে বা অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে কষ্ট পায়। মানুষের রিজিক শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার মৃত্যু হয় না। বিশ্ব প্রতিপালক মহান আল্লাহর ঘোষণা ‘ভূপৃষ্ঠের সব প্রাণীর জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহ নিজে গ্রহণ করেছেন।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ৬)