বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানের একটি। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত যদি ইনসাফভিত্তিক বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা না থাকে, তাহলে ওই রাষ্ট্র আদর্শ ও কল্যাণমূলক হতে পারে না। এখানে সুপ্রিম কোর্টের কথা যেমন বলা হচ্ছে, তেমনি গ্রাম আদালত বা শালিসি বিচারব্যবস্থার কথাও বলা হচ্ছে। সব জায়গায় বিচার চলবে ইনসাফভিত্তিক। ইসলামি জীবন দর্শনের সৌন্দর্য হলো, তুমি যে অবস্থায় আছ সেখান থেকেই ধর্মের চর্চা শুরু করতে পার।
আমাদের দেশ বহুদলীয় গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে বহু মত-পথের মানুষ নিজ নিজ স্বাধীনতা রক্ষা করে চলে। ইসাফভিত্তিক বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা তাই বেশি জরুরি। আজ থেকে আমরা যদি সিদ্ধান্ত নিই অন্যায়-অবিচার-বেইনসাফি এ শব্দগুলো দেশের বিচারব্যবস্থা থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করব; মুহর্তেই মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাবে। বাংলাদেশে ইনসাফভিত্তিক বিচারব্যবস্থা কায়েম করা বেশ সহজ। এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ ইসলামপ্রিয়, কোরআনপ্রিয়, আল্লাহ, আল্লাহর রসুল ভক্ত, আউলিয়া ভক্ত।
ইসলামের ধর্ম-দর্শন টিকেই আছে ইনসাফের ওপর। যদিও এখন আমরা লোভে পড়ে ইনসাফ ভুলে অন্যায়-জুলুমের পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছি। তবে কোরআন হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমাদের। ইনসাফভিত্তিক বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নবীজিকে বলেন, ‘হে নবী! আপনি কি তাদের দেখেছেন, যারা নিজেদের কোরআনের অনুসারী দাবি করে এবং দাবি করে পূর্ববর্তী আসমানি গ্রন্থে বিশ্বাসী বলে; কিন্তু তারা নিজেদের মামলা-মোকদ্দমার জন্য ইনসাফভিত্তিক আদালতে না গিয়ে তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হয়। অথচ তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ইনসাফভিত্তিক বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং তাগুতের বিরোধিতা করার জন্য। আসলে শয়তান চায় তারা যেন হেদায়াতের সরল পথ থেকে অনেক দূরে ছিটকে যায়’ (সুরা নিসা-৬০ নম্বর আয়াতের ভাব তরজমা)।
আয়াতটির শানে নুজুল সম্পর্কে বেশ কয়েকটি ঘটনা পাওয়া যায়। সব ঘটনা প্রায় একই রকম। রসুল (সা.) মদিনায় ইনসাফভিত্তিক বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই সন্তুষ্টচিত্তে সে বিচারব্যবস্থা মেনে নিয়েছে। কিন্তু কিছু নামধারী মুসলমান-মুনাফিক সে বিচারব্যবস্থা মেনে নিতে পারেনি। তারা মুখে দাবি করে কোরআন মেনে নিয়েছি, পূর্ববর্তী সব আসমানি গ্রন্থে বিশ^াস করি; কিন্তু নিজেদের মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনার জন্য এমন ব্যক্তি বা আদালতের কাছে যায় যেখানে ইনসাফ নয় অর্থের জোরে রায় পাওয়া যায়। এমন আদালত ও বিচারককে কোরআনের ভাষায় তাগুত বলা হয়েছে। আরবি তাগুত শব্দটি এসেছে ‘তুগয়ান’ শব্দ থেকে।
ইমাম ফখরুদ্দিন রাজি (রহ.) বলেছেন, তাগুত শব্দটি কোরআনে পাঁচটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাগুতের এক অর্থ সীমালঙ্ঘনকারী। এ আয়াতে তাগুত বলতে বিভ্রান্ত-অবিবেচক-মিথ্যা বিচারককে বোঝানো হয়েছে। যে বিচারক ঘুষ খেয়ে রায় বদলে দেন সেই তাগুত। কেননা বিচারের যে সীমা ছিল সেটা তিনি লঙ্ঘন করে ফেলেছেন।
মুফাসসিররা এ আয়াতের শানে নজুল সম্পর্কে চারটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে প্রসিদ্ধ ঘটনাটি বিশর নামক মুনাফিককে নিয়ে। তার সঙ্গে এক ইহুদির জমি-সম্পর্কিত বিরোধ ছিল। ইহুদি বলল, ‘চলো! আমরা এ মোকদ্দমার ফয়সালা মুহাম্মদের (সা.) কাছ থেকে নিই।’ মুনাফিক মনে মনে ভাবল, নবীজির ইনসাফের আদালতে গেলে নির্ঘাত ইহুদির পক্ষে রায় আসবে। কেননা এখানে ইহুদিই সঠিক। তাই নবীজির কাছে যাওয়া যাবে না। সে বলল, ‘মুহাম্মদ নয় বরং তোমাদের নেতা কাব বিন আশরাফের কাছে চলো।’ কাব বিন আশরাফ ছিল চরম ঘুষখোর। সে ঘুষ খেয়ে রায় বদলে দিত। ইহুদি বলল, ‘ঘটনা কী? আমি যেতে চাচ্ছি তোমাদের নবীর কাছে, আর তুমি চাচ্ছ আমাদের নেতা বিচার করে দিক!’ অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা দুজন নবীজির কাছে গেলেন।
নবীজি (সা.) তদন্ত শেষে যথারীতি ইনসাফভিত্তিক বিচার করে দিলেন এবং রায় গেল ইহুদির পক্ষে মুনাফিকের বিপক্ষে। এরপর ঘটনা আরও লম্বা। মুনাফিক নবীজির বিচার মানতে চাইল না। সে হজরত ওমরের কাছে গিয়ে আপিল করে। হজরত ওমর নবীজির বিচার না মানার কারণে তাকে হত্যা করেন। এ পুরো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সুরা নিসার ৬০ নম্বর আয়াত নাজিল হয়। (তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন, ২য় খণ্ড, ৪১৫-৪১৬ পৃষ্ঠা)। পাঠক! লক্ষ করুন, ইনসাফভিত্তিক আদালত প্রতিষ্ঠা হলে জুলুমের অবসান হবে।
মজলুম ন্যায়বিচার পাবে। স্বজনপ্রীতি-দলপ্রীতি চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। মুফাসসিররা লিখেছেন, ইহুদি হওয়া সত্ত্বেও সে নবীজির কাছে বিচার চাইতে গিয়েছিল। কারণ সে জানত ইনসাফ যেখানে প্রতিষ্ঠিত সেখানে ন্যায়বিচার পাওয়া যাবেই। ধর্ম-বর্ণ কিংবা গোত্র এ ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলবে না। একইভাবে ওই ইহুদি নিজের ধর্মীয় নেতার কাছে বিচার চাইতে অস্বীকার করেছে। কেননা কাব বিন আশরাফের আদালত ইনসাফভিত্তিক ছিল না। সেটা ছিল ঘুষের আদালত।
গবেষকরা বলেন, শরিয়তে কোনো জবরদস্তির ব্যবস্থা নেই। ভিন্নধর্মীর মানুষ চাইলে ইনসাফের আদালতে আসতে পারে। আবার বেইনসাফির আদালতেও যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে তাদের জোর করা হবে না। তবে মুসলমানকে অবশ্যই আদালতে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। আল্লাহ আমাদের বোঝার তৌফিক দিন।
মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী