গাজা বা পশ্চিম তীর থেকে দূরত্ব ১৩ হাজার কিলোমিটারের বেশি। কিন্তু আরব বিশ্বের বাইরে যে দেশটিতে সর্বোচ্চ সংখ্যক ফিলিস্তিনি থাকেন সেটি হলোশ্ব দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলি। সেখানে প্রায় পাঁচ লাখের মতো ফিলিস্তিনি বসবাস করেন। চিলিতে বসবাসকারী এই ফিলিস্তিনিরা সেখানে থেকেই দখলদার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জোরালো আওয়াজ তুলছেন।
ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের পর থেকে চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে হাজারো ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি হামলার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার বিক্ষোভ করেছে। বিক্ষোভে তারা ফিলিস্তিনের ঐতিহ্যবাহী স্কার্ফ ‘কুফিয়া’ পরে প্ল্যাকার্ড হাতে প্রতিবাদ করেছে। প্রতিকূলতা, নিপীড়নের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার মতো বা ‘এটা যুদ্ধ নয়, গণহত্যা’ এমন প্রতিবাদী নানা স্লোগান দিয়ে তারা মুখর করে তোলে সান্তিয়াগোর রাস্তা।
চিলিতে বাস করা ফিলিস্তিনিদের অনেকেরই আত্মীয়স্বজন গাজা উপত্যকায় বা এর কাছাকাছি থাকে। ইসরায়েল সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করার পর সেসব স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করাটাও তাদের জন্য কঠিন হয়ে গেছে। তারা পুরো সংকটটাকে অন্তর থেকে অনুভব করেন।
কিন্তু কীভাবে চিলির লোকজনের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে এতটা সুসম্পর্কের বন্ধন গড়ে উঠল? এত বেশি সংখ্যক ফিলিস্তিনিই বা কেন এত দূরের একটা দেশে পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল?
চিলিতে ফিলিস্তিনিদের অভিবাসন বুঝতে ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে যেতে হবে। জর্ডান নদী আর ভূমধ্যসাগরের মধ্যে ফিলিস্তিন অঞ্চল শাসন করত অটোমানরা। মুসলমান, ইহুদি ও খ্রিস্টান, সবার জন্যই জায়গাটা পবিত্র। ‘ফিলিস্তিনি, সিরিয়ান এবং লেবানিজরা এক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দেশ ছেড়ে যেতে শুরু করে। তখন এ অঞ্চলে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ও প্রথম আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের দমনের সময় চলছিল,’ বলছিলেন রিকারডো মারজুকা, যিনি ইউনিভার্সিটি অপ চিলির সেন্টার ফর অ্যারাব স্টাডিজের একজন শিক্ষাবিদ।
পরে অনেক তরুণ ফিলিস্তিনি তখন স্থলপথে ইউরোপের সেখান থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেসে যেতে থাকে। আর্জেন্টিনার রাজধানী ছিল তুলনামূলক ধনী এবং ইউরোপের মতো। কিন্তু সেখান থেকেও অনেকে আন্দিজ পাড়ি দিয়ে চিলির দিকে যেতে থাকে। হয়তো একরকম অজানা গন্তব্যের আকর্ষণেই।
১৮৮৫ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে চিলিতে আট থেকে দশ হাজারের মতো আরব ছিল। এই তথ্য লেখক লরেঞ্জো আগার করবিনসলার বই ‘দ্য অ্যারাব ওয়ার্ল্ড ইন ল্যাটিন আমেরিকার।
সেই আরবদের অর্ধেকই ছিল ফিলিস্তিনি যাদের অধিকাংশই তিনটি শহর থেকে এসেছিলশ্ব বেথেলহেম, বেইত জালা আর বেইত সাহুর। তিনটি শহরই জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরে (ফিলিস্তিনের ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক অংশ) অবস্থিত। কিন্তু এরপর ভিন্ন ধরনের অভিবাসন শুরু হলো। যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙে যেতে শুরু করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে যখন ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের দিনটি ফিলিস্তিনিদের কাছে ‘নাকবা’ বা বিপর্যয়ের দিন হিসেবে পরিচিত, কারণ তখন তাদের জন্য একজাতীয় সংকটের শুরু হয়। সেই সময় প্রায় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনিদের অন্য দেশে পালাতে হয় নয়তো ইহুদি সেনাদের দ্বারা বিতাড়িত হতে হয়।
নব্য অনেক দেশের মতো চিলির অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে এবং তাদের ভূখণ্ডকে জনবহুল করতে অভিবাসীদের প্রয়োজন ছিল। চিলির অভিজাতরা সাধারণত ইউরোপীয়দের পছন্দ করত, যাদের ঊনবিংশ শতকের শুরু থেকে ভূমি ও নানা অধিকার দেওয়া হয়েছিল। তবে সেটার সুযোগ নেয় অনেক ফিলিস্তিনি এবং অন্যান্য আরবরা।
https://bangla-bnb.saturnwp.link/electracity-bill/
এই আবাসনের পেছনে বেশ কয়েকটি বিষয় কাজ করে। একটি হচ্ছে জলবায়ু, কারণ চিলির আবহাওয়ার সঙ্গে ফিলিস্তিনের বেশ মিল রয়েছে। আরেকটি হচ্ছেশ্ব স্বাধীনতা, যেটা অটোমান ও পরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দমনের কারণে তাদের জীবনে ছিল না! আরও একটি কারণ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। যারা মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসেছিল তারা বাণিজ্য এবং টেক্সটাইল শিল্পকে বেছে নিয়েছিল যেটা এ অঞ্চলকে সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা রাখবে।