মানবতার মুক্তির দূত হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন জগদ্বাসীর জন্য রহমত স্বরূপ। দল, মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে জগতের এমন কোনো মানুষ নেই, যার সুখ শান্তি ও মুক্তির জন্য নবীজি চোখের পানি ফেলেননি। শুধু মানব সম্প্রদায়ের কথাই বা বলি কেন? জীবজন্তু, পশুপাখি, গাছপালা, তরুলতা সবার জন্যই তিনি ছিলেন রহমত। আজকের নিবন্ধের এই ক্ষুদ্র পরিসরে আমরা কেবল অমুসলিমদের ব্যাপারে তিনি কেমন দয়াদ্র ছিলেন তা তুলে ধরার প্রয়াস চালাবো-
এক. স্থায়ী মুক্তির পথ দেখাতে ছিলেন বেকারার
চাচা আবু তালিব মৃত্যুশয্যায় শায়িত। শিয়রে দাঁড়িয়ে আছেন প্রিয় ভাতিজা মুহাম্মদে আরাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। কাতর কণ্ঠে অনুরোধ জানাচ্ছেন— চাচা জীবনের অন্তিমলগ্নে কেবল কালিমাটুকু একবার পড়ুন। আমি আপনার জন্য সুপারিশ করবো। বাধা হয়ে দাঁড়ালেন পাশে দাঁড়ানো আবু জাহেল। বললেন— লোকে বলবে, আবু তালিব শেষ জীবনে বাপ-দাদার ধর্ম ত্যাগ করেছিল। তিনি প্রভাবিত হলেন। নিজে পূর্বপুরুষের ধর্মের ওপরই অটল রইলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম চোখের পানি মুছলেন। তবুও তার মুক্তির দোয়া বন্ধ করলেন না। বললেন— সুস্পষ্ট নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত আমি দোয়া চালিয়ে যাব। এবারে আয়াত নাযিল হলো।
দুই. রোগীর শুশ্রুষায় প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
এক ইহুদী বালক। নবীজির খেদমত করেন। ফুট ফরমায়েশ খাটেন। দিন কয়েক হয় তাকে দেখা যাচ্ছে না। জানতে পেলেন, সে খুব অসুস্থ। রোগীর শুশ্রুষায় ছুটে চললেন। স্নেহভরে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন— তুমি আল্লাহর ওপর ঈমান আনো। সে পাশে দাঁড়ানো বাবার দিকে তাকালো। তিনি সায় দিলেন। জানালেন, তুমি চাইলে আবুল কাসেম এর আহ্বানে সারা দিতে পারো। সে ঈমান আনলো। ইসলামের অমিয় সুধা পান করে অনন্ত অসীম জিন্দেগানির চিরসুখ নিশ্চিত করল।
তিন. সামাজিক ও সেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ
তখন মাত্র ২০ বছরের যুবক। বনু হাশেম, যোহরা ও তাইম; আরবের এই তিন গোত্রের কতিপয় যুবক আব্দুল্লাহ ইবনে জুদআনের ঘরে সমবেত হয়ে এক ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদন করল। পৃথিবীর ইতিহাসে যা হিলফুল ফুজুল নামে প্রসিদ্ধ। তার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন রাসূলের সম্মানিত চাচা যুবাইর ইবনে আব্দুল মুত্তালিব। তিনি তাতে অংশ নেন। ন্যায় ও ইনসাফের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এই যুবকদের শপথ বাক্য ছিল এমন— পৃথিবীর সাগর-মহাসাগরে যতদিন একটি পশম ভেজানোর মতো পানি থাকবে, ততদিন আমরা অসহায় ও মজলুমের পক্ষে লড়ে যাবো। যেন ফিরিয়ে দেওয়া হয় তার অধিকার। ততদিন সমাজ জীবনে আমরা থাকবো একে অপরের প্রতি সমবেদনাশীল।
রাসূল সা. ছিলেন সেই যুবকদের একজন। যিনি ছিলেন হিলফুল ফুজুলের অন্যতম সংগঠক। ভবিষ্যতে নবওয়তী জীবনেও তিনি তাতে সমর্থন জানিয়েছিলেন। হাদিসে এসেছে, নবীজি বলেন— ইসলামের পূর্বে আব্দুল্লাহ ইবনে জুদআনের ঘরে আমি একটি সেবামূলক চুক্তিতে অংশগ্রহণ করেছিলাম। ইসলাম আসার পরও যদি আমাকে তাতে ডাকা হতো তাহলে অবশ্যই আমি সাড়া দিতাম। সেদিন তারা শপথ করেছিল, প্রত্যেককে তার অধিকার ফিরিয়ে দিবে। এবং কোনো জালেমকে মজলুমের ওপর চড়াও হতে দেবে না।
চার. অমুসলিমদের ওপর জুলুম প্রতিরোধে ভূমিকা
নবীজি সাল্লাহু সাল্লাম বলেন, সাবধান! যে ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ কোনো অমুসলিমের ওপর জুলুম করল কিংবা তার কোনো ক্ষতি করল, অথবা তার ওপর সাধ্যের অতীত কোনো বিষয়ে চাপিয়ে দিল, কিংবা সন্তুষ্টি ছাড়া তার থেকে কোনো কিছু কেড়ে নিল, কেয়ামতের দিন আমি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করব।
অন্য হাদিসে বলেন- যে ব্যক্তি অমুসলিম নাগরিককে অনর্থক কষ্ট দিলো আমি তার প্রতিপক্ষ। আর আমি যার প্রতিপক্ষ তার সঙ্গে আমার বোঝাপড়া হবে কেয়ামতের দিন।
বিশিষ্ট সাহাবী হযরত ইবনে সামেত রা. একবার গোত্তা অঞ্চলের একটি গ্রামের ওপর দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, যার নাম দুম্মার। তিনি গোলামকে আদেশ করলেন যাও বাড্ডা নদীর তীরবর্তী সাফসাফ গাছ থেকে একটি মিসওয়াক কেটে আন। আনার জন্য রওনা হলে তিনি হঠাৎ ডাক দিয়ে বললেন, ফিরে এসো মিসওয়াক আনতে হবে না। কারণ এখন যদিও তা কাঁচা ডাল, তাই মূল্য নেই। কিন্তু অচিরেই তা শুকিয়ে লাকড়ি হয়ে যাবে, যা বাজারে বিক্রি করা হয়। সুতরাং বিনিময় ছাড়া নেওয়া ঠিক হবে না।
পাঁচ. জীবনের নিরাপত্তা বিধানে নবীজি সা.
নবীজি বলেন— যে ব্যক্তি কোনো চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমকে অন্যায়ভাবে হত্যা করবে, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ তার ঘ্রাণ পাওয়া যায় ৪০ বছরের দূরত্ব থেকেও। তিনি আরও বলেন— আল্লাহ ও তার রাসূল যে অমুসলিমকে নিরাপত্তা দিয়েছেন, তাকে যে হত্যা করলো, সে আল্লাহ তাআলার নিরাপত্তা বিধান লঙ্ঘন করল। সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ তার ঘ্রাণ পাওয়া যায় ৭০ বছরের দূরত্ব থেকে।
ছয়. যুদ্ধের ময়দানে সতর্কতা প্রসঙ্গ
ন্যায় ও আদর্শ প্রতিষ্ঠা আর অন্যায় অনাচার ও জুলুম প্রতিহতে যুদ্ধ একটি অনিবার্য বাস্তবতা। সেই যুদ্ধকালীন সময়েও অমুসলিম শত্রুদের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত আচরণের ব্যাপারে ইসলাম কতটা সজাগ। তার প্রতীয়মান হয় রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশনা থেকে।
যেকোনো বাহিনীকে যুদ্ধে পাঠানোর সময় তিনি নির্দেশনা দিতেন এই বলে— আল্লাহর নামে রওনা হও। তবে সাবধান, দুর্বল বৃদ্ধকে হত্যা করো না। অবশ্যই সুখে হত্যা করো না, অবলা নারীকে হত্যা করো না। কারো সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গ করো না, গনিমতের মাল এক জায়গায় জমা করো। মানুষের সংশোধনের চেষ্টা করবে। মানুষের প্রতি দয়া করবে, কেননা আল্লাহ দয়াশীলদের ভালোবাসেন।
এটা শুধু বাণীতেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং তার সাহাবায়ে কেরাম রেদওয়ান আজমাঈন তাদের বাস্তব জীবনে তার প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন। ফলে দেখা যায় আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু যুদ্ধে পাঠানোর সময় এই দশটি নসিহত করতেন— কখনো কোনো নারীকে হত্যা করবে না, কোনো শিশুকে হত্যা করবে না, কোনো দুর্বল বৃদ্ধকে হত্যা করবে না, কোনো ফল গাছ কাটবে না, আবাদি ফসলের মাঠ নষ্ট করবে না, খাবার উদ্দেশ্য ছাড়া কোনো বকরি হত্যা করবে না, কোনো খেজুর বাগান কাটবে না, খেজুর বাগান পোড়াবে না, গনিমতের মালা প্রসাদ করবে না, কাপুরুষতা করবে না।
যুদ্ধের আগে এক মজলিসে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেন— শোনো কোনো ফসলের ক্ষেত মারাবে না, আমিরের অনুমতি ছাড়া কোনো কিছু গ্রহণ করবে না, অমুসলিম নাগরিকদের কোনো সম্পদ জবর দখল করবে না, তাদের একটি দুটি উট ছিনিয়ে নিয়ে তুমি দাবি করো না যে আমি বড় বাহাদুর। উঠে গিয়ে হযরত ইবনে আব্বাস সাথে সাক্ষাত করলেন, তিনিও অনুরূপ কথাগুলো বলেছিলেন।
মৃত্যুশয্যায় হযরত ওমর রা. পরবর্তী খলিফার জন্য যে ওসিয়াতনামা লিখিয়েছিলেন সেই সংক্ষিপ্ত অসিয়তেও তিনি অমুসলিমদের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে কথা বলতে ভুলেননি। তাতে লিখেন, আমি আমার পরবর্তী খলিফাকে আরও উপদেশ দিচ্ছি যে, অমুসলিম নাগরিকদের জন্য আল্লাহ ও তার রাসূলের নিরাপত্তা বিধানকে যথাযথভাবে রক্ষা করবে। প্রয়োজনে তাদের পক্ষে লড়াই করবে এবং সাধ্যের অতীত কোনো বিষয় তাদের ওপর চাপিয়ে দিবে না।
মোটকথা অমুসলিমদের জান মাল ইজ্জত আব্রু রক্ষায় রাসূলে কারীম সা. এর আন্তরিকতা ছিলো নজীরবিহীন। পাশের বিভিন্ন দেশে একের পর এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলেও আমাদের এই দেশে পারস্পরিক সৌহার্দ্য সম্প্রীতি ও ভালোবাসার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনে এ শিক্ষাটিই সবচেয়ে বেশি কার্যকর। এটিই ইসলামের মূল সৌন্দর্য। যে সৌন্দর্যের বলে আরবের গুহা থেকে পথচলা এ দীন ছড়িয়ে পড়ছে দিক দিগন্তে। হৃদয় থেকে হৃদয়ে।