রাজশাহী-৬ আসন থেকে ২০০৮ সালে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন শাহরিয়ার আলম। আওয়ামী লীগ সরকারের তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পেয়েছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর। প্রথমবার নির্বাচনী হলফনামায় ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি ভূমিহীন। ছিল ২ কোটি ৩ লাখ ২০ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ, যার বিপরীতে ঋণ ছিল ৭৬ কোটি ১৪ লাখ ২৯ হাজার ৪২২ টাকা।
এমন ‘ঋণগ্রস্ত’ একজন ব্যক্তি এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে হয়ে যান হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক।
অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে বদলি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ঢাকা ও নিজ এলাকায় হাজার কোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের মালিক হয়েছেন শাহরিয়ার আলম। রাশিয়া, ব্রাজিল ও চীনে অর্থ পাচার করে তিনি গড়ে তুলেছেন নিজস্ব অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে আটটি পোশাক কারখানার মালিকানা রয়েছে শাহরিয়ার আলমের।
নিজেকে আড়াল করার প্রচেষ্টা হিসেবে নিয়েছেন মিডিয়ার মালিকানাও। রেনেসাঁ গ্রুপের নামে ‘দুরন্ত’ টেলিভিশনের মালিক সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী। রাজশাহীতে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ঢাকার গুলশানে নিজের নামে দুটি, ছেলের নামে একটি এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর নামে নিয়েছেন ৩ হাজার ৬০০ বর্গফুটের রাজকীয় ফ্ল্যাট। সর্বশেষ ২০২৪ সালের হলফনামায় কৃষি ও অকৃষি জমি দেখিয়েছেন অন্তত ৫১ বিঘা।
অথচ ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে জমা দেওয়া হলফনামার তথ্য অনুযায়ী শাহরিয়ার আলমের স্থাবর কোনো সম্পদই ছিল না।
নিজ ও পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কমিশন থেকে সম্প্রতি শাহরিয়ারের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দেওয়া হয় অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশনাও।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের চলমান দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সদ্য সাবেক ক্ষমতাসীন মন্ত্রী-এমপি ও আমলাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান কাজ চলমান আছে।
দুদকের গোয়েন্দা অনুসন্ধানে শাহরিয়ার আলমের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত পাওয়ায় কমিশন থেকে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অনুসন্ধানে প্রকৃত সত্য উদঘাটিত হবে। অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, শাহরিয়ার আলম দুর্নীতি-অনিয়মের পাশাপাশি অর্থ পাচার করে রাশিয়া, ব্রাজিল ও চীনে নিজস্ব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছেন। ২০০৮ সালের হলফনামায় তার অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয়েছিল সব মিলিয়ে ২ কোটি ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। বিভিন্ন কম্পানির নামে ঋণ ছিল ৭৬ কোটি ১৪ লাখ ২৯ হাজার ৪২২ টাকা। ২০২৪ সালের নির্বাচনে তিনি অস্থাবর সম্পদ দেখান ৮৯ কোটি ২৪ লাখ ৯ হাজার ৯৭৩ টাকার। আর নিজের কম্পানির নামে থাকা ৭৬ কোটি টাকার ঋণও পরিশোধ হয়ে গেছে দেখান। অর্থাৎ এই সময়ে তিনি অন্তত ১৬৫ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তার দুই ছেলের অস্থাবর সম্পদ ছিল মাত্র ৭৯ লাখ ১০ হাজার ৬৬২ টাকা। পাঁচ বছরে তাদের অস্থাবর সম্পদ বেড়ে হয়েছে ৭ কোটি ৪৫ লাখ ১ হাজার ৪৮২ টাকা।
সম্পদের বিবরণের বিষয়ে আরো জানা যায়, প্রথমবার এমপি হওয়ার পর ২০১০ সালে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার চৌধুরীহাট এলাকায় ২৫ বিঘা জমি কেনেন শাহরিয়ার আলম। সেখানে তিনি গড়ে তুলেছেন বাংলোবাড়ি, গরুর খামার, টিস্যু কালচার ল্যাব ও বনসাই গবেষণাগার। ওই জমি দেখিয়ে ২০০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণও নিয়েছেন। এ ছাড়া রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বসন্তপুরে প্রতিষ্ঠা করেছেন নর্থ বেঙ্গল অ্যাগ্রো ফার্মস লিমিটেড।
লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায়ও ২০১৭ সালে ১৩ বিঘা জমি কেনেন শাহরিয়ার আলম। সেখানেও গড়ে তোলা হয়েছে খামারবাড়ি। বিভিন্ন দামি সবজি, মাছসহ নানা ধরনের ফসলের চাষাবাদ করা হচ্ছে সেখানে। মূলত শাহরিয়ার আলমের ছোটবেলা কেটেছে লালমনিরহাট জেলায়। সেই সুবাদে সেখানে জমি কিনে খামারবাড়ি গড়ে তুলেছেন। তার দীর্ঘদিনের এপিএস সিরাজের বাড়িও এই কালীগঞ্জ উপজেলায়।
শাহরিয়ার আলম তার নির্বাচনী আসন রাজশাহী-৬ (চারঘাট-বাঘা) এলাকায় পোশাক কারখানা স্থাপনসহ নানা প্রলোভন দেখিয়ে স্বল্পমূল্যে কিনে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকার জমি। যার মধ্যে রয়েছে ৩৩ শতক জমি, ভবনসহ সিনেমা হল এবং উপজেলা ভূমি অফিসের পূর্ব পাশের ৩৩ শতাংশ জমিসহ আরো অনেক জমি।
প্রথম স্ত্রী আয়েশা আক্তার ডালিয়াকে তালাক দিয়ে নাটোরের লালপুরে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার কন্যা সিলভিয়া পারভীন লেনিকে বিয়ে করেন শাহরিয়ার আলম। অভিযোগ রয়েছে, দ্বিতীয় স্ত্রী লেনির মা রোকসানা মর্তুজা লিলিকে ২০২১ সালে নিজের খাটিয়ে মেয়র বানান তিনি। স্ত্রী লেনিকেও ঢাকার গুলশানে ৩ হাজার ৬০০ স্কয়ার ফুটের রাজকীয় ফ্ল্যাট উপহার দেন।
সূত্র বলছে, ২০০৮ সালে এমপি হওয়ার পর অর্থসম্পদ গড়ে তোলার নেশায় শাহরিয়ার আলম তার নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক লুটপাট ও চাাঁদাবাজি করেন। তিনি তার এপিএস সিরাজুল ইসলামের মাধ্যমে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন টিআর-কাবিখাসহ সরকারি সব অনুদান ও প্রকল্প। এমনকি স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক নিয়োগেও করেন ঘুষ বাণিজ্য। চাকরি, বদলিসহ বিভিন্ন কাজে এপিএসের মাধ্যমে নেন মোটা অঙ্কের ঘুষ।
২০০৮ সালে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার সময় ১০ লাখ ৫ হাজার টাকা দামের হোন্ডা সিআরভি মডেলের গাড়িতে চড়তেন শাহরিয়ার আলম। সর্বশেষ তাকে ১ কোটি ১ লাখ ৩ হাজার ১০০ টাকা দামের লাক্সারি গাড়িতে চড়তে দেখা যায়। তার স্ত্রীর ব্যবহার করা গাড়িও ১ কোটি ১৬ লাখ ২৫ হাজার ৫৭৫ টাকা দামের বলে জানা গেছে।