আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা রূপান্তরের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে কি না সম্প্রতি এমন বিতর্ক শুরু হয়েছে বিশ্বের এআই কমিউনিটিতে। কারণ বিশ্বের খ্যাতনামা ও শীর্ষস্থানীয় এআই প্রতিষ্ঠান ওপেন এআইর তৈরি ‘এআই মডেল’র পরবর্তী সংস্করণের অগ্রগতি তার পূর্ববর্তী সংস্করণের অগ্রগতির তুলনায় খুবই সামান্য বলে জানিয়েছে মার্কিন বাণিজ্যবিষয়ক সংবাদমাধ্যম বিজনেস ইনসাইডার।
সান ফ্রান্সিসকো ভিত্তিক প্রযুক্তি বিষয়ক পোর্টাল ‘দ্য ইনফরমেশন’-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দ্রুত বিকাশমান এআই শিল্প সম্ভবত তার সীমাবদ্ধতার শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে, এই বিষয়টি তারই ইঙ্গিত।
ওপেন এআইর পরবর্তী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক মডেল ‘ওরিয়ন’ খুব সামান্যই অগ্রগতি প্রদর্শন করছে তার পূর্বসূরী ‘জিপিটি ফোর’ এর তুলনায়। ওপেন এআইর কর্মীদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে দ্য ইনফরমেশন। ‘ওরিয়ন’ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত কর্মীরা দ্য ইনফরমেশনকে জানায়, বুদ্ধিমত্তা ও সামর্থ্যে জিপিটি থ্রি’র থেকে জিপিটি ফোর যে পরিমাণ এগিয়ে ছিল, ওরিয়নের ক্ষেত্রে এই উন্নতির চিহ্ন খুব সামান্যই পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে কোডিংয়ের ক্ষেত্রে এই সীমাবদ্ধতা আরও বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এর পেছনে দুটি কারণ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তার মধ্যে একটি হলো তথ্যের সীমাবদ্ধতা। এআই মডেল যে সব উপাদানের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘স্কেলিং ল ইকুয়েশন’। আর এই ‘স্কেলিং ল ইকুয়েশন’ যা নিয়ে কাজ করে তা হলো ডাটা বা তথ্য। ‘স্কেলিং ল ইকুয়েশন’র জন্য এই তথ্য সংগ্রহ করা হয় অনলাইন থেকে।
তবে অনলাইন থেকে তথ্য পাওয়ার বিষয়টি দিন দিন সঙ্কুচিত হয়ে আসছে নতুন এআই মডেলের জন্য। কারণ ইতোমধ্যেই অনলাইনে থাকা প্রায় সব তথ্যই জানা হয়ে গেছে বিদ্যমান এআই মডেলের।
মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক টুলস ও ফিচারের ব্যাপারে এই এআই মডেলগুলোকে প্রশিক্ষিত করতে ব্যবহার করা হয় মানুষের তৈরি বিপুল পরিমাণ তথ্য। যার মধ্যে রয়েছে টেক্সট, ভিডিও, গবেষণা পত্র, গল্প উপন্যাস ইত্যাদি। তবে মনুষ্য উৎপাদিত এসব তথ্যের যোগান সীমিত।
এ ব্যাপারে গত জুন মাসে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইপোক এআই’ পূর্বাভাস দিয়ে বলেছিল যে, আগামী ২০২৮ সালের মধ্যেই এআই মডেলগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এ পরিস্থিতিতে অবশ্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক মডেল নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলো এআই মডেলের নিজের তৈরি কৃত্রিম বা সিনথেটিক ডাটার দিকে ঝুঁকছে, কিন্তু সেখানেও সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ডাটা ব্রিকসের সহপ্রতিষ্ঠাতা আয়ন স্টয়কা দ্য ইনফরমেশনকে বলেন, কৃত্রিম বা সিনথেটিক ডাটার থেকে প্রকৃত বা ফ্যাকচুয়াল ডাটা এক্ষেত্রে বেশি কার্যকর।
এছাড়া এআই মডেলের পারফর্মেন্সের ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো কম্পিউটিং দক্ষতা। পরবর্তী প্রজন্মের এআই মডেল প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে এই কম্পিউটিং শক্তিরও সীমাবদ্ধতা বর্তমানে পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিষয়টি নিজেই স্বীকার করেছেন ওপেন এআই এর প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান।
গত মাসে অনলাইন কমিউনিটি নেটওয়ার্ক রেডিট এ ‘আস্ক মি এনিথিং’ থ্রেড এ স্যাম অল্টম্যান বলেন, প্রয়োজনীয় কম্পিউটিং সামর্থ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাদের প্রতিষ্ঠান ব্যাপক সীমাবদ্ধতা ও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে।
অবশ্য খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা অনেক আগেই এ ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়ে আসছিলেন। তাদের মতে বর্তমানে যে সব এআই মডেল বাজারে আসছে, সেগুলো থেকে শুরু করে ভবিষ্যতে আসতে যাওয়া এআই মডেলগুলোও তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সক্ষমতার দিক থেকে পূর্ববর্তী মডেলগুলোর থেকে খুব সামান্যই এগিয়ে থাকবে।
বিশ্বজুড়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে উন্মাদনা বা এআই হাইপের বিরুদ্ধে যারা সরব, তাদের মধ্যে অন্যতম নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির এমেরিটাস অধ্যাপক গ্যারি মার্কাস। তার মতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উন্নতি করার সুযোগ কমে আসছে, এবং খুব শিগগিরই তার সামর্থ্যের শেষ বিন্দুতে পৌঁছে যাবে।
এমনকি ওপেন এআইর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান অ্যানথ্রোপিক এর গত জুন মাসে বাজারে ছাড়া এআই মডেল ‘ক্লড থ্রি পয়েন্ট ফাইভ’ এর দক্ষতা ও সামর্থ্য নিয়েও হতাশা ব্যক্ত করেন অধ্যাপক গ্যারি মার্কাস। ‘ক্লড থ্রি পয়েন্ট’ বাজারে আসার পর মারকাস নিজের ’এক্স’ পোস্টে বলেছিলেন, ‘ক্লড থ্রি পয়েন্ট ফাইভ’ তার প্রতিদ্বন্দ্বী অন্যান্য মডেলের তুলনায় খুব বেশি উন্নতি করতে পারেনি। এর দক্ষতাও অন্যান্য এআই মডেলের মতোই একই বৃত্তে আবদ্ধ।
অবশ্য সমালোচকদের সমালোচনা সত্ত্বেও স্যাম অল্টম্যানসহ সিলিকন ভ্যালির টেক জগতের অন্যান্য মহারথীরা অবশ্য এখনও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যত নিয়ে অনেকখানিই আশাবাদী। তাদের মধ্যে অন্যতম মাইক্রোসফটের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা কেভিন স্কট। সম্প্রতি দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নতির অগ্রগতি সীমিত হয়েছে এমন মনোভাবকে নাকচ করে দেন তিনি।
এদিকে সেপ্টেম্বর মাসে বাজারে আসা নিজেদের নতুন মডেল ‘ওপেন এআই জিরো ওয়ান’কে আগের মডেলগুলোর থেকে তুলনামূলক অনেক বেশি দক্ষ বলে অভিহিত করছে ওপেন এআই কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবি, জটিল সমস্যা সমাধান এবং কঠিন প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ব্যাপারে ওপেন এআই জিরো ওয়ান তার পূর্বসূরী মডেলের থেকে অনেক বেশি দক্ষ। এমনকি পদার্থ, রসায়ন এবং জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন প্রশ্ন ও সমাধানের ক্ষেত্রে পিএইচডি মানের শিক্ষার্থীদের সমমানের দক্ষতা দেখিয়েছে এই মডেল, এমনটাই দাবি ওপেন এআই কর্তৃপক্ষের।