স্বপ্ন নিয়ে মানুষের কৌতূহল বহু কালের। স্বপ্ন যেমন মানুষকে হাসায়-কাঁদায়, তেমনি রোমন্টিক ও দুঃখবিলাসীও করে তোলে। স্বপ্ন নিয়ে তাই যুগ যুগ ধরে মানব সমাজে তৈরি হয়েছে নানা মিথ। এসব মিথের সঙ্গে বাস্তবতা ও বিজ্ঞানের ফারাক যোজন যোজন।
তবুও মানুষ এই একবিংশ শতাব্দিতে এসেও স্বপ্ন নিয়ে সমান রোমান্টিসিজমে ভোগে। বিশ্বাস করে, স্বপ্নের ভেতরেই রয়েছে ব্যক্তির ভাগ্য নির্ধারণের চাবিকাঠি, স্বপ্নের ব্যাখ্যো খুঁজে পেলেই আগাম ভবিষ্যৎ জেনে ফেলা সম্ভব। এ বিষয়ে বিজ্ঞান কী বলে, চলুন জেনে নেওয়া যাক।
বিজ্ঞানীদের মতে, স্বপ্ন হলো মস্তিষ্কের বিশেষ এক প্রক্রিয়া।
এই প্রক্রিয়ায় স্মৃতির পুনর্গঠন, আবেগ এবং মানসিক অবস্থার প্রতিফলন ঘটে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মস্তিষ্ক, ঘুম ও স্বপ্ন নিয়ে অস্ট্রিয়ান মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড ব্যাপক গবেষণা করেন। তাঁর বিখ্যাত বই ‘ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিমস’-এ বলেন, স্বপ্ন হলো আমাদের অবচেতন মনের প্রতিফলন। ফ্রয়েডের মতে, স্বপ্নের মাধ্যমে আমাদের ভেতরকার চাপা আবেগ, ইচ্ছা এবং ভয় প্রকাশ পায়।
স্বপ্ন ভবিষ্যত জীবনের পূর্বাভাস—এ তত্ত্বের বিরোধী ছিলেন তিনি। তবে তিনি এও মনে করতেন, স্বপ্ন আমাদের মানসিক অবস্থার আভাস দেয়। সেই আভিস ভবিষ্যতের কার্যক্রমকে প্রভাবিত করতে পারে।
স্বপ্ন সম্পর্কে ফ্রয়েডের শিষ্য সুইস বিজ্ঞানী কার্ল জুংয়ের ধারণা ছিল একটু ভিন্ন। তিনি মনে করতেন, স্বপ্ন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং সম্মিলিত অবচেতন মনের প্রতিফলন।
স্বপ্ন আমাদের মানুষের মনের গভীরে জমে থাকা পুরানো স্মৃতিকে প্রকাশ করে। অর্থাৎ জুংয়ের মতে, স্বপ্ন ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানসিক অবস্থার দিকে ইঙ্গিত দেয়। গুরু ফ্রয়েডের মতো তিনিও মনে করতেন, স্বপ্ন সরাসরি ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দেয় না।
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকিয়াট্রি বিভাগের গবেষক রবার্ট স্টিকগোল্ড। তিনি বর্তমানে স্বপ্ন নিয়ে আধুনিক গবেষণা করছেন। তাঁর মতে, স্বপ্ন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের তথ্য প্রক্রিয়াজাত করার একটি পদ্ধতি। মস্তিষ্ক স্বপ্নের মাধ্যমে আগের অভিজ্ঞতা পুনর্গঠন করে এবং এগুলি থেকে শেখার চেষ্টা করে। এই প্রক্রিয়ায় মস্তিষ্ক ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে তার প্রস্তুতি নেয়। তবে স্বপ্ন ভবিষ্যতের সঠিক পূর্বাভাস কখনোই দেয় না—এমনটাই মনে করেন স্টিকগোল্ড।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষক জে অ্যালান হবসন একজন স্বপ্ন বিষয়ক গবেষক। তিনি মনে করেন, স্বপ্ন হলো মস্তিষ্কের একধরনের ‘অ্যাক্টিভেশন সিন্থেসিস ‘ প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় মস্তিষ্কের নিউরনগুলোর নানা কার্যকলাপের ফলে স্বপ্ন সৃষ্টি হয়। তিনিও মনে করেন, স্বপ্নের মাধ্যমে ভবিষ্যতের কোনো ঘটনা সুনির্দিষ্টভাবে পূর্বাভাস করা সম্ভব নয়। তবে, স্বপ্ন মানসিক এবং শারীরিক প্রস্তুতির অন্যতম মাধ্যম।
যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকোলজির অধ্যাপক মার্ক ব্লাগ্রোভ স্বপ্নের সমাজিক ও মানসিক প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁর মতে, স্বপ্ন কখনো কখনো আমাদের আবেগ, সামাজিক সমস্যা বা উদ্বেগের প্রতিফলন হতে পারে। স্বপ্ন ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্ককে সচল রাখে এবং নানা ধরনের চিন্তা, মানসিক অবস্থা এবং অভিজ্ঞতা প্রক্রিয়াজাত করে।
গবেষকরা মনে করেন, আমাদের মস্তিষ্কের একটি প্রধান কাজ হলো স্মৃতি সংরক্ষণ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ। স্বপ্নের মাধ্যমে মস্তিষ্ক আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতাগুলি পুনরায় সাজায় এবং কখনো কখনো এগুলি বিশৃঙ্খল বা বিচ্ছিন্ন আকারে চলতে শুরু। অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ স্বপ্নের সাথে বাস্তব ঘটনার মিল খুঁজে পান। ফলে স্বপ্নকে ভবিষ্যতের পূর্বাভাস ভাবার যে প্রবণতা, সেটা জোরালো হয়। তবে আজ পর্যন্ত কোনো গবেষণায় স্বপ্নকে ভবিষ্যতের পূর্বাভাস হিসেবে প্রমাণ করা যায়নি।