ধূমপান, বিষাক্ত রাসায়নিক বা তেজস্ক্রিয় বিকিরণের সংস্পর্শে আসা কিংবা জিনগত অস্বাভাবিকতা এবং জিনের নানারকম ক্ষতির কারণে ক্যানসার হতে পারে, এ আমরা সবাই জানি। ক্যানসার হতে পারে আরও নানা কারণে। তবে ক্যানসারের একটি কারণ নিয়ে আলোচনা হয় না বললেই চলে। সেটি হলো ভাইরাস। শুনে হয়তো অবাক হচ্ছেন; ভাবছেন, আসলেই কি ভাইরাস থেকে ক্যানসার হতে পারে?
কমপক্ষে ৭টি ভাইরাস রয়েছে, যেগুলো থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্যানসার হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস বা এইচপিভি, হেপাটাইটিস বি ভাইরাস বা এইচবিভি, হেপাটাইটিস সি ভাইরাস বা এইচসিভি, এপস্টাইন-বার ভাইরাস বা ইবিভি, কপোসির সারকোমা-সম্পর্কিত হার্পিসভাইরাস, হিউম্যান টি-সেল লিম্ফোট্রপিক ভাইরাস এবং মার্কেল সেল পলিওমা ভাইরাস। এ ছাড়া ইউম্যান ইমিউনোডেফিশিয়েন্সি ভাইরাস মানুষের শরীরে আক্রমণ করলে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে।
তবে এ সব ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের মধ্যে খুব কম মানুষই এখন পর্যন্ত ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন। সহজ কথায়, কারো শরীরে এই সাত ভাইরাসের দুই-একটির সংক্রমণ ঘটলেই যে তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত হবেন, তা নয়। বিশ্বের ৯০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে এপস্টাইন-বার ভাইরাসে আক্রান্ত হন। তবে তাঁদের মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ মানুষ আক্রান্ত হন ক্যানসারে।
২০১২ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সে বছর যত মানুষের ক্যানসার হয়েছিল, তার ১০ শতাংশ, অর্থাৎ ১ কোটি ৪০ লাখের বেশি মানুষ এসব ভাইরাসের সংক্রমণের ফলেই ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষক জে বারজোফস্কি। তিনি জানান, ‘দীর্ঘদিন অনেকে সন্দিহান ছিলেন যে দেহে কোনো ভাইরাসের আক্রমণ হলে হয়তো ক্যানসার হতে পারে। পরে যখন কয়েকজন ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর দেহে এ ভাইরাসের কয়েকটা পাওয়া গেছে, তখন তাঁরা আরও বেশি ভয় পেয়ে যান।’
বেরজোফস্কির মতে, এ সব ভাইরাস প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্যানসার সৃষ্টিকারী প্রভাব ফেলতে পারে। প্রতিটি ভাইরাস অনন্য উপায়ে সৃষ্টি করতে পারে ক্যানসার। তবে এই সাত ভাইরাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারেন এইচপিভি ভাইরাসের কারণে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ৩৭ হাজারের বেশি মানুষ এই ভাইরাসের কারণে ক্যানসারে আক্রান্ত হন। স্বাভাবিক স্বাস্থ্যকর কোষগুলোকে অস্বাভাবিক ও টিউমারযুক্ত কোষে পরিণত করে এ ভাইরাস। ধীরে ধীরে এই অস্বাভাবিক কোষ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের এমডি অ্যান্ডারসন ক্যানসার সেন্টারের সংক্রামক রোগের অধ্যাপক হ্যারিস টরেস বলেন, ‘এসব ভাইরাস অস্বাভাবিক কোষগুলোকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে দেয়।’ বর্তমানে ২০০টির বেশি ধরনের এইচপিভি ভাইরাস রয়েছে। এর মধ্যে শুধু ১২টি ক্যানসারের জন্য দায়ী। শিশুদেরও এ ভাইরাস আক্রমণ করতে পারে। তাই অনেক দেশে ১১-১২ বছর বয়সীদের এইচপিভি ভ্যাকসিন দেওয়া হয়।
আবার অনেক ভাইরাস সরাসরি ক্যানসারের জন্য দায়ী না হলেও পরোক্ষভাবে শরীরের ক্ষতি করে। যেমন এইচবিভি ও এইচসিভি লিভার বা যকৃতে আক্রমণ করে। দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ হলে যকৃতের ক্ষত বাড়ে। এ থেকে বাড়ে ক্যানসারের ঝুঁকি।
তবে আশার কথা হলো, এসব ভাইরাস প্রতিরোধের ব্যবস্থাও রয়েছে। যেমন এইচপিভি ও এইচবিভির ভ্যাকসিন বা টিকা এখন পাওয়া যায়। স্কটল্যান্ডে করা একটি সার্ভে বা জরিপে দেখা গেছে, ১২-১৩ বছর বয়সে যেসব কিশোরী এই টিকা নিয়েছে, তাদের মধ্যে সার্ভিক্যাল ক্যানসারে (জরায়ুমুখের ক্যানসার) আক্রান্ত হয়েছে, এমন নতুন কোনো ঘটনা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এ ছাড়া অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসার সাহায্যে এইচআইভি ও দীর্ঘস্থায়ী এইচবিভির মতো সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচা যায়। এর সাহায্যে এইচসিভি সংক্রণও নিরাময়যোগ্য। অর্থাৎ ভাইরাস থেকে ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা থাকলে টিকা, প্রতিরোধ ও চিকিৎসার সাহায্যে এ সব ভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকা যায়।