সময়ের পালাবদলে ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো হয়ে উঠেছে বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। ওয়েব সিরিজগুলোর গল্পের বিষয়বৈচিত্র্য আর নান্দনিক নির্মাণের কারণে যা উঠে এসেছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এত অল্প সময়ে আমাদের ওয়েব সিরিজগুলো এমন সফলতা পাবে, তা হয়তো অনেকেই ভাবেননি। অবাক করা বিষয় হচ্ছে শুধু দেশি দর্শক নয়, বিদেশি দর্শকের মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছে একের পর এক সিরিজ। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের আলোচিত ও তরুণ নির্মাতারা দর্শক-প্রত্যাশা পূরণ করছেন।
অন্যদিকে অভিনয়শিল্পীরা বারবার নিজেকে ভেঙে নতুনরূপে পর্দায় তুলে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বড় বিষয় হলো, ভালো কাজের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারছে প্রতিটি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। ‘মহানগর’, ‘কারাগার’, ‘তাকদীর’, ‘ষ’, ‘সাবরিনা’, ‘নেটওয়ার্কের বাইরে’, ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান’, ‘বোধ’, ‘দুই দিনের দুনিয়া’, ‘কাইজার’, ‘মরীচিকা’, ‘কন্ট্রাক্ট’, ‘জাগো বাহে’, ‘শাটিকাপ’, ‘বলি’ থেকে শুরু করে ‘গুটি’ পর্যন্ত দেশীয় নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পীদের বেশকিছু ওয়েব সিরিজ ও ছবি দর্শক প্রশংসা কুড়িয়েছে। যদিও শুরুর দিকে বেশিরভাগ সিরিজে অপরাধজগতের গল্পই প্রাধান্য পেয়েছে। তবে এখন সেখান থেকে সরে এসে নানা ধরনের গল্প নিয়ে তৈরি হচ্ছে একেকটি সিরিজ। যে কারণে নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং শিল্পীরাও এখন পা রাখছেন ওয়েব দুনিয়ায়, যার সুবাদে আরও বর্ণিল হয়ে উঠছে দেশীয় ওয়েব সিরিজগুলো।
এবার একটু ওয়েব সিরিজ ও ওয়েব ছবির গল্পের দিকে নজর দেওয়া যাক। শিহাব শাহীনের ‘আগস্ট ১৪’ ও রায়হান রাফির ওয়েব ছবি ‘জানোয়ার’-এ আমরা নির্মম বাস্তবতার চিত্র দেখতে পাই। খবরে প্রকাশিত ঘটনা থেকে আমাদের কল্পনা যে চিত্র তৈরি করে নেয়, তা থেকে চোখে দেখা ঘটনা কতটা আলাদা হতে পারে তারই উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে এ দুটি সিরিজ ও ছবিতে। অন্যদিকে আশফাক নিপুণের ‘মহানগর’ কাল্পনিক ঘটনার বয়ান হলেও তা যাপিত জীবনে ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতার ছায়া তুলে ধরে। মোশাররফ করিমের অনবদ্য অভিনয় দর্শককে বুঝতে দেয়নি এ কেবলই গল্প। একই নির্মাতার ‘সাবরিনা’ সিরিজে আমরা দেখতে পাই দুই নারীর নতুন এক আখ্যান। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তার ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান’ সিরিজে তুলে ধরেছেন নারী-পুরুষের সম্পর্কের জটিলতা এবং পুরুষশাসিত সমাজের এক কঠিন সত্য। সেই সত্য অনিন্দ্য অভিনয় দিয়ে দর্শকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন তাসনিয়া ফারিণ ও অন্য শিল্পীরা। অনম বিশ্বাসের ‘দুই দিনের দুনিয়া’ সিরিজে গল্প রচিত হয়েছে পীর-ফকিরের নানা কিংবদন্তির আলোকে। যে কারণে বহুবার বহুভাবে পর্দায় তুলে ধরা অপরাধ আর শাস্তির গল্পের সঙ্গে দুই দিনের দুনিয়ার গল্প মেলানো যায় না। এ জন্য চঞ্চল চৌধুরী, ফজলুর রহমান বাবু, মৌসুমী হামিদসহ সিরিজের প্রতিটি চরিত্র মনে হয় অনেক দিনের চেনা; চোখে দেখা রক্ত-মাংসের মানুষ। অন্যদিকে তামিম নূর ও কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের ‘কন্ট্রাক্ট’, শিহাব শাহীনের ‘মরীচিকা’সহ বেশকিছু সিরিজ সিনেমাপ্রেমীদের তৃষ্ণা মিটিয়েছে। পাশাপাশি মিজানুর রহমান আরিয়ানের ওয়েব ছবি ‘নেটওয়ার্কের বাইরে’ ছিল প্রচলিত সিনেমার ধারা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার নতুন উদাহরণ। শঙ্খ দাশগুপ্তের ‘বলি’-তে আমরা পেয়েছি ক্ষমতার লড়াইয়ে মেতে ওঠার নতুন এক গল্প। আবার পুরোপুরি ভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করতে দেখা গেছে বেশকিছু নির্মাতাকে। চিরায়ত ভৌতিক গল্পকেও যে নতুনভাবে পর্দায় তুলে ধরা যায়, তার প্রমাণ মেলে নুহাশ হুমায়ূনের ‘ষ’ সিরিজ দেখে।
একইভাবে দর্শককে চমকে দিয়ে সৈয়দ আহমেদ শাওকী তার দুটি সিরিজ ‘তাকদীর’ ও ‘কারাগার’-এ উপস্থাপন করেছেন নতুন স্বাদের দুই গল্প। যেখানে চঞ্চল চৌধুরী, আফজাল হোসেন, ইন্তেখাব দিনারের মতো অভিনেতাদের দর্শক আরও একবার ভিন্নরূপে আবিষ্কারের সুযোগ পেয়েছেন। অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধনকেও নতুনরূপে দেখা গেছে শঙ্খ দাশগুপ্তের ‘গুটি’ সিরিজে। এভাবেই একেকটি সিরিজের একেক ধরনের গল্প দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে। বাড়িয়ে দিয়েছে ওয়েব সিরিজের ক্ষুধা। এ জন্য ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো একটি সিরিজের এক সিজন শেষ হতে না হতেই ঘোষণা দিয়ে চলেছে নতুন সিজনের। দর্শকরাও গুণে চলছেন প্রতীক্ষার প্রহর।
https://bangla-bnb.saturnwp.link/data-entry/
এখন কথা হলো, ওয়েব সিরিজের এই উত্থানের পেছনে কারণ কী? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, নির্মাতারা বড় বাজেটে স্বাধীনভাবে কাজের সুযোগ পাচ্ছেন, যার সুবাদে সাহসী হতে পারছেন বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সৃষ্টির নেশায় মেতে ওঠার। তবুও ঘুরেফিরে অপরাধের গল্পই প্রাধান্য পেয়ে আসছে। এর কারণ কী হতে পারে? নির্মাতা গিয়াসউদ্দিন সেলিম বলেন, ‘শুরুতে গল্প নির্বাচনে যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে, তা থেকে আমরা কিন্তু সরে আসছি। প্রথমে আমাদের প্রয়োজন ছিল দর্শকের কাছে নাটক, টেলিছবি ও ওয়েব সিরিজের পার্থক্য তুলে ধরা। এরপর যেখানে বৈচিত্র্য যোগ করা। শুরুতে কী প্রাধান্য পেয়েছে তা মুখ্য নয়। বরং প্রতিটি ধাপ কীভাবে অতিক্রম করছি, সেটিই দেখার।’