‘কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি’ শব্দটি প্রথম চালু করেন ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির পদার্থবিজ্ঞানী জন প্রেসকিল। সেই ২০১২ সালে। তখন অনেক বিজ্ঞানী অবিশ্বাসে মাথা নেড়েছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, কোন ডিজিটাল কম্পিউটারকে ছাড়িয়ে যেতে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের লেগে যেতে পারে কয়েক শতাব্দী না হলেও অন্তত কয়েক দশক। সর্বোপরি, সিলিকন চিপের ওয়েফারের বদলে প্রতিটি আলাদা আলাদা পরমাণুর ওপর কম্পিউটিং করা ভয়াবহ কঠিন ভাবা হতো। কারণ স্রেফ অতিসামান্য কম্পন বা গোলমালও কোয়ান্টাম কম্পিউটারের পরমাণুগুলোর সূক্ষ্ণ নৃত্যে গোলযোগ সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি সম্পর্কে এই বিস্ময়কর ঘোষণাগুলো এখন নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়েছে। সেখান থেকে এখন ভাবনাটা সরে এসেছে। এখন মূল ভাবনা হল, ক্ষেত্রটার উন্নয়ন কতটা দ্রুত এগিয়ে চলছে।
এ অসাধারণ সফলতার কারণে যে কম্পনের সৃষ্টি হয়েছে, তা নাড়া দিয়েছে বিশ্বের নানা দেশের বোর্ডরুম ও শীর্ষ গোপন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও। হুইসেল ব্লোয়ারদের মাধ্যমে ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা গেছে, মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি এ ক্ষেত্রের উন্নয়নগুলো খুবই কড়া নজরদারিতে রেখেছে। কারণ কোয়ান্টাম কম্পিউটার এতই শক্তিশালী যে তাত্ত্বিকভাবে এই যন্ত্র আমাদের জানা সব ধরনের সাইবারকোড ভেঙে ফেলতে সক্ষম। তার মানে, বিভিন্ন দেশের সরকার অতি সর্তকভাবে যেসব গোপনীয়তা রক্ষা করে—যেগুলো তাদের মুকুটের রত্মের মতো সবচেয়ে সংবেদনশীল তথ্য সম্বলিত—সেগুলো আসলে আক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে। এমনকি বিভিন্ন কর্পোরেশন ও ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ গোপনীয়তাও এখন হুমকির মুখে। সেটা এতই জরুরি পরিস্থিতি যে সম্প্রতি বড় কর্পোরেশন ও সংস্থাগুলো এই নতুন যুগে অনিবার্য পরিবর্তনের পরিকল্পনা করতে সহায়তার জন্য গাইডলাইন ইস্যু করা হয়েছে। সেটি ইস্যু করেছে মার্কিন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেকনোলজি (এনআইএসটি)। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নীতি ও মান নির্ধারণ করে এ প্রতিষ্ঠান। এনআইএসটি এরই মধ্যে ঘোষণা করেছে যে ২০২৯ সালের মধ্যে কোয়ান্টাম কম্পিউটার ১২৮ বিটের এইএস এনক্রিপশন ভেঙে ফেলতে সক্ষম হবে। কোডটি (128-bit AES) এখন ব্যবহার করছে বেশকিছু কোম্পানি।
আলী এল কাফারানি ফোবর্স ম্যাগাজিনে লিখেছেন, ‘যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য সংবেদনশীল তথ্য সুরক্ষার জন্য এটি একটি ভয়াবহ আশঙ্কা।’
ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি ফর কোয়ান্টাম ইনফরমেশন সায়েন্সে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছে চীন সরকার। কারণ এই গুরুত্বপূর্ণ ও দ্রুত পরিবর্তনশীল ক্ষেত্রটিতে নেতৃত্ব স্থান পেতে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বিভিন্ন জাতি এই কোডগুলো রক্ষা করতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মতো অস্ত্র সজ্জিত হয়ে কোনো হ্যাকার হয়তো এ গ্রহের যেকোনো ডিজিটাল কম্পিউটারের সুরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে গুড়িয়ে দিতে পারবে। তারপর বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ক্ষয়ক্ষতির শিকার হবে। এমনকি বাদ যাবে না সামরিক বাহিনিও। তখন সকল সংবেদনশীল তথ্য হয়তো হস্তগত হবে সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মাধ্যমে ওয়াল স্ট্রিটের ভেতরের খাস কামরায় ঢোকা যাবে। সে কারণে অস্থিরতার মুখে পড়বে আর্থিক বাজারগুলো। ব্লকচেইনও হয়তো আনলক করতে পারবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। তাতে বিটকয়েন বাজারেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি অনিবার্য। অডিট, কনসালটিং ও ফাইনানশিয়াল সার্ভিস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ডেলোটি হিসেব কষে দেখেছে, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মাধ্যমে হ্যাকিংয়ের ঝুঁকিতে রয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ বিটকয়েন।
‘যারা এই ব্লকচেইন প্রজেক্টগুলো চালাচ্ছে, তারা সম্ভবত নার্ভাসভাবে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের অগ্রগতির দিকে তাকিয়ে থাকবে।’ সিবি ইনসাইট নামের একটা ডেটা সফটওয়্যার আইটি কোম্পানি একটা প্রতিবেদনের উপসংহার টেনেছে এই কথাটি দিয়ে।
কাজেই বৈশ্বিক অর্থনীতি ঝুঁকির মুখে রয়েছে। সেটা ডিজিটাল প্রযুক্তির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ওয়াল স্ট্রিট ব্যাংকগুলো মাল্টি বিলিয়ন ডলারের লেনদেনের ট্র্যাক রাখতে কম্পিউটার ব্যবহার করে। আকাশচুম্বী ভবন, সেতু ও রকেটের নকশা করতে কম্পিউটার ব্যবহার করেন প্রকৌশলীরা। হলিউডের ব্লকব্লাস্টার মুভিগুলো প্রাণবন্তভাবে ফুটিয়ে তুলতে কম্পিউটারের ওপর নির্ভর করেন শিল্পীরা। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো কম্পিউটার ব্যবহার করেন তাদের পরবর্তী বিস্ময়কর ওষুধ তৈরি করতে। শিশুরা তাদের বন্ধুদের সঙ্গে সর্বশেষ প্রকাশিত ভিডিও গেম খেলতে কম্পিউটারের ওপর নির্ভর করে। আমাদের বন্ধু, সহযোগী ও আত্মীয়দের কাছ থেকে তাৎক্ষণিক খবরাখবর পেতে সেলফোনের ওপর নির্ভর করি আমরা। নিজেদের ফোনগুলো খুঁজে না পেলে আতঙ্কিত হওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের প্রায় সবারই আছে। আসলে মানুষের এমন কোনো কার্যকলাপের কথা এখন বলা খুবই কঠিন, যেগুলো কম্পিউটারের কারণে পরিবর্তন হয়নি। কম্পিউটারের ওপর আমরা এতই নির্ভরশীল যে কোনোভাবে যদি বিশ্বের সব কম্পিউটার হুট করে বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে গোটা মানবসভ্যতা চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে হাবুডুবু খাবে। তাই বিজ্ঞানীরা এত গভীরভাবে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের উন্নয়ন পর্যবেক্ষণ করছেন।
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের উত্থানে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে সিলিকন যুগ ক্রমান্বয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। গত অর্ধ শতকে কম্পিউটারের ক্ষমতার আকস্মিক বৃদ্ধিকে বর্ণনা করা হতো মূরের সূত্রের মাধ্যমে। ইন্টেলের প্রতিষ্ঠাতা গর্ডন মুরের নামে এ সূত্রের নামকরণ করা হয়েছে। মূরের সূত্র অনুসারে, প্রতি ১৮ মাসে কম্পিউটারের ক্ষমতা হবে দ্বিগুণ। এই সহজ সূত্রই কম্পিউটারের ক্ষমতার লক্ষণীয় সূচকীয় বৃদ্ধি অনুসরণ করে আসছে। মানবজাতির ইতিহাসে এই বাড়ার হার নজিরবিহীন। এত অল্প সময়ের মধ্যে এ ধরনের ব্যাপক প্রভাব ফেলা আমাদের আর কোনো উদ্ভাবণের কপালে ঘটেনি।
ইতিহাসে কম্পিউটারকে পেরিয়ে আসতে হয়েছে অনেকগুলো পর্যায়। প্রতিটি পর্যায়েই এ যন্ত্রের ক্ষমতা বেড়েছে ব্যাপকভাবে। সেইসঙ্গে ঘটিয়েছে বড় ধরনের সামাজিক পরিবর্তনও। আসলে মুরের সূত্রটি ১৮০০-এর প্রথম দশকের মেকানিকেল কম্পিউটার যুগ পর্যন্ত পিছিয়ে বিস্তৃত করা যায়। সে যুগে ঘূর্ণমান সিলিন্ডার, খাঁজকাটা চাকা, গিয়ার ও হুইল ব্যবহার করে সাধারণ পাটিগণিতের কাজ করতেন প্রকৌশলীরা। গত শতাব্দীতে এসব ক্যালকুলেটর বা গণকযন্ত্রগুলোতে বিদ্যুতের ব্যবহার শুরু হয়। তখন গিয়ার বাদ দিয়ে যুক্ত করা হয় রিলে ও তার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সরকারের গুপ্ত কোড ভাঙতে কম্পিউটারে সারি সারি করে সাজানো বিপুল সংখ্যক ভ্যাকুয়াম টিউব ব্যবহার করা হতো। এই যুদ্ধের পর দেখা গেল এক ক্রান্তিকালের। গতি ও শক্তি অব্যাহতভাবে বাড়াতে ভ্যাকুয়াম টিউবের বদলে ট্রান্সজিস্টরের ব্যবহার শুরু হল। ট্রানজিস্টর মাইক্রোস্কোপিক আকৃতির মতো ছোট করে বানানো সম্ভব।
কোনো কিছুই চিরকাল টিকে থাকে না। দেখা গেছে, কম্পিউটারের বিকাশের প্রতিটি ক্রান্তিকাল এক সৃজনশীল ধ্বংস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আগের প্রযুক্তিকে অকেজো করে তুলেছে।
১৯৫০-এর দশকে মেইনফ্রেম কম্পিউটারগুলো কিনতে পারতো কেবল পেন্টাগন এবং আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলোর মতো বড় কর্পোরেশন ও সরকারি সংস্থাগুলো। সেগুলো বেশ ক্ষমতাসম্পন্ন ছিল (যেমন ইনিয়াক কম্পিউটার ত্রিশ সেকেন্ডে যে কাজ করতে পারত, সেটা কোন মানুষের করতে লাগত প্রায় ২০ ঘন্টা)। তবে সেগুলোর দাম ছিল খুবই চড়া। তবে প্রায়ই একটা অফিসের গোটা একটা তলার জায়গা দখল করত ওইসব কম্পিউটার। মাইক্রোচিপের উদ্ভাবণ এ গোটা প্রক্রিয়ায় বিপ্লব বয়ে এনেছে। কারণ কয়েক দশক ধরে এর আকার ক্রমাগত কমেছে। তাতে আপনার নখের মতো আকৃতির একটা সাধারণ চিপে এখন রাখা সম্ভব প্রায় এক বিলিয়ন সংখ্যক ট্রানজিস্টর। বর্তমানে ভিডিও গেম খেলার জন্য শিশু-কিশোররা যে সেল ফোন বা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে, তা এককালে পেন্টাগনের নাদুস-নুদুস ডাইনোসরের মতো পুরো ঘরভর্তি কম্পিউটারের তুলনায় অনেক গুণ শক্তিশালী। নির্দ্বিধায় স্বীকার করা যায়, আমাদের পকেটে যে কম্পিউটার থাকে, তার শক্তি স্নায়ুযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত যেকোন কম্পিউটারের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।
কোনো কিছুই চিরকাল টিকে থাকে না। দেখা গেছে, কম্পিউটারের বিকাশের প্রতিটি ক্রান্তিকাল এক সৃজনশীল ধ্বংস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আগের প্রযুক্তিকে অকেজো করে তুলেছে। মুরের সূত্র এরই মধ্যে ধীর গতির হতে শুরু করেছে। একসময় হয়তো তা থেমেও যাবে। তার কারণ হল, মাইক্রোচিপ এতই কমপ্যাক্ট বা ঘনবিন্যস্ত যে ট্রানজিস্টরের সবচেয়ে পাতলা স্তরটির বিস্তৃতি লম্বালম্বি করে রাখা প্রায় ২০টি পরমাণু জায়গায় পৌঁছে গেছে। সেটা যখন প্রায় পাঁচটি পরমাণুর জায়গায় পৌঁছাবে, তখন ইলেকট্রনের অবস্থান হয়ে যাবে অনিশ্চিত। তাতে চিপ থেকে ইলেকট্রন নিঃসৃত হয়ে চিপে সর্টসার্কিট হতে পারে। কিংবা এত বেশি তাপ তৈরি হতে পারে, যাতে চিপটি গলে যাবে। অন্য কথায়, পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র অনুসারে, আমরা যদি প্রধানত সিলিকন ব্যবহার অব্যাহত রাখি, তাহলে মুরের সূত্র অতি অবশ্যই ধীরে ধীরে অকেজো হয়ে পড়বে। এভাবেই আমরা সাক্ষী হতে পারি সিলিকন যুগের সমাপ্তির। আমাদের অগ্রগতির পরের ধাপটি হতে পারে সিলিকন পরবর্তী বা কোয়ান্টাম যুগ।
ইন্টেলের সঞ্জয় নটরাজন বলেছেন, ‘আমরা চেপে ধরেছি। আমরা বিশ্বাস করি, এ নকশারীতিতে সবকিছুই ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে।’
সবকিছু এখন শান্ত বলে মনে হলেও আগে বা পরে এই নতুন ভবিষ্যতের সূচনা হবে। গুগলের এআই ল্যাবের পরিচালক হার্টমুট এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘মনে হচ্ছে কিছুই ঘটছে না। কিছুই না। তারপর হুট করে একদিন ঢুকে যাবেন ভিন্ন কোনো জগতে।’
পরমাণু হল ঘূর্ণমান লাটিমের মতো। এক চুম্বকীয় ক্ষেত্রে পরমাণুগুলো চুম্বকীয় ক্ষেত্রটির সাপেক্ষে উপরে বা নিচে (আপ বা ডাউন) সারিবদ্ধ হতে পারে।
এগুলো এত শক্তিশালী কেন?
প্রশ্ন হল, কোনো জিনিসটা কম্পিউটারকে এত শক্তিশালী বা ক্ষমতাসম্পন্ন করেছে? আর তার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নতুন এ প্রযুক্তি হাতের মুঠোয় পেতে এমন মরিয়া হয়ে উঠছে?
আসলে আধুনিক সব কম্পিউটার গড়ে উঠেছে ডিজিটাল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। এই ডিজিটাল তথ্য ০ এবং ১-এর সিরিজে এনকোড করা যায়। তথ্যের সবচেয়ে ছোট একক, অর্থাৎ একক ডিজিটকে বলা হয় এক বিট। ০ ও ১-এর অনুক্রম ডিজিটাল প্রসেসরে দেওয়া হয়। সেটাই গণনাগুলো সম্পাদন করে আউটপুট তৈরি করে। যেমন আপনার ইন্টারনেট সংযোগ মাপা হয় হয়তো বিট পার সেকেন্ড বা বিপিএস-এর প্রেক্ষিতে। তার মানে, এক বিলিয়ন বিট আপনার কম্পিউটারে পাঠানো হচ্ছে। এ কারণে মুভি, ইমেইল, ডকুমেন্ট ইত্যাদিতে মুহূর্তের মধ্যেই ঢুকতে পারছেন।
যাইহোক, ডিজিটাল তথ্য ভিন্ন এক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছিলেন নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান। ‘দেয়ার’স প্নেন্টি অব রুম অব দ্য বটম’ শিরোনামে তাঁর লেখা ভবিষ্যদ্বাণীমূলক ও প্রবর্তনমূলক এক রচনায় এবং পরের আরও কিছু রচনায় তিনি প্রশ্ন তোলেন: এই ০ আর ১-এর সিকোয়েন্সকে পরমাণুর দশা দিয়ে প্রতিস্থাপন করে পারমাণবিক কম্পিউটার তৈরি করি না কেন? ট্রানজিস্টরগুলো সম্ভাব্য সবচেয়ে ছোট বস্তু বা পরমাণু দিয়ে প্রতিস্থাপন করি না কেন?
পরমাণু হল ঘূর্ণমান লাটিমের মতো। এক চুম্বকীয় ক্ষেত্রে পরমাণুগুলো চুম্বকীয় ক্ষেত্রটির সাপেক্ষে উপরে বা নিচে (আপ বা ডাউন) সারিবদ্ধ হতে পারে। সেটা অনেকটা ০ ও ১-এর মতো। আপনার কম্পিউটারে এই সংখ্যা দুটোর (০ ও ১) দশার সঙ্গে ডিজিটাল কম্পিউটারের শক্তি সম্পর্কিত।
কিন্তু অতিপারমাণবিক জগতের নিয়ম-কানুন উদ্ভট। তাই পরমাণুগুলো এ দুটি দশার যেকোনো সমাহারে স্পিন করতে বা ঘুরতে পারে। যেমন এমন দশাও পাওয়া সম্ভব, যেখানে পরমাণুটি ১০ শতাংশ সময় থাকবে আপ স্পিনে এবং ৯০ শতাংশ সময় থাকবে ডাউন স্পিনে। কিংবা ৬৫ শতাংশ সময় আপ স্পিন থাকবে এবং ৩৫ শতাংশ সময় থাকবে ডাউন স্পিন। আসলে পরমাণুর স্পিন বা ঘূর্ণনের উপায় আছে অসীম সংখ্যক। এটিই সম্ভাব্য দশার সংখ্যা ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দেয়। কাজেই পরমাণুটি তথ্যও বহন করতে পারে অনেক বেশি। কেবল এক বিট নয়, বরং এক কিউবিট। অর্থাৎ একই সময়ে ঘটা আপ ও ডাউন দশার সমাহার। ডিজিটাল বিটগুলো একবারে মাত্র এক বিট তথ্য বহন করতে পারে। সেটাই তাদের ক্ষমতা বা শক্তিকে সীমিত করে তোলে। কিন্তু কিউবিট বা কোয়ান্টাম বিটের শক্তি বা ক্ষমতা প্রায় সীমাহীন। ঘটনা হল, পারমাণবিক পর্যায়ে বস্তু একাধিক একই সময়ে একাধিক দশায় থাকতে পারে। একে বলা হয় সুপারপজিশন। (এর আরেকটা মানে হল, সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত সূত্রগুলো পারমাণবিক পর্যায়ে নিয়মিত লঙ্ঘন করা হয। সেই পরিসরে ইলেকট্রন একই সময়ে দুটি স্থানে থাকতে পারে। কিন্তু সেটা বড় বস্তুর ক্ষেত্রে সত্য নয়।)
আরও ব্যাপার হল, এসব কিউবিট পরস্পরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করতে পারে। কিন্তু সাধারণ বিটের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। এই কাজটিকে বলা হয় এনট্যাঙ্গেলমেন্ট বা বিজড়ন। ডিজিটাল বিটগুলোর স্বাধীন দশা বা অবস্থা থাকে। সেখানে প্রতিবার যখনই আরেকটা কিউবিট যোগ করা হবে, তা আগের সবগুলো কিউবিটের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করবে। ফলে সম্ভাব্য মিথস্ক্রিয়ার সংখ্যা এর ফলে দ্বিগুণ হয়ে যাবে। কাজেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার সহজাতভাবেই ডিজিটাল কম্পিউটারের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। কারণ প্রতিবার একটি অতিরিক্তি কিউবিট যোগ করে আপনি মিথস্ক্রিয়ার সংখ্যা দ্বিগুণ করে দিতে পারবেন।
যেমন বর্তমানে কোয়ান্টাম কম্পিউটারে থাকতে পারে ১০০ কিউবিটের বেশি। তার মানে, সেগুলো এক কিউবিটের সুপার কম্পিউটারের চেয়ে ২১০০ গুণ বেশি শক্তিশালী।
গুগলের সাইকোমোর কোয়ান্টাম কম্পিউটার প্রথমবারের মতো কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি অর্জন করেছিল। এ কম্পিউটার তার ৫৩ কিউবিট দিয়ে ৭২ বিলিয়ন বিলিয়ন বাইট মেমোরি প্রসেস করার ক্ষমতা রাখে। কাজেই সাইকোমোরের মতো কোয়ান্টাম কম্পিউটারই বর্তমানে প্রচলিত যেকোনো কম্পিউটারকে হারিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
https://bangla-bnb.saturnwp.link/%e0%a6%9a%e0%a6%be%e0%a6%81%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%89%e0%a6%aa%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6%e0%a7%87%e0%a6%b0/
এর বাণিজ্যিক ও বৈজ্ঞানিক প্রয়োগের ক্ষেত্র অপরিসীম। আমাদের ডিজিটাল বিশ্ব অর্থনীতি থেকে কোয়ান্টাম অর্থনীতিতে রূপান্তর হওয়া সময় তার সম্ভাবনাটা অসাধারণভাবে বেশি।