ঘরোয়া বাগানে ফলমূল এবং সবজি উৎপাদন সবসময়েই পরিবেশ বান্ধব বলে মনে করা হয়, কিন্তু এখন ধারণা করা হচ্ছে, এটি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে লড়াইয়েও একটি অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে।
ঠিক এই অভিজ্ঞতা হয়েছে বাংলাদেশের একটি এলাকার বাসিন্দাদের, যখন তাদের খাবার ও আয় রোজগারের প্রধান ফসল ধান মৌসুমি বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যায়।
বাংলাদেশের সিলেট বিভাগে ২০১৭ সালের এপ্রিলে আগাম অতিবৃষ্টির কারণে তাদের ক্ষেতের সব ধান নষ্ট হয়ে যায়। অথচ ওই বছর বৃষ্টি শুরু হওয়ার কথা ছিল আরো দুই মাস পরে।
কৃষকদের বেশিরভাগ ফসলই বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যায়। যার অর্থ হলো – বছরের বাকি সময়ের জন্য তাদের আর কোন আয় ছিল না, পরিবারের জন্য যথেষ্ট খাবারও ছিল না।
জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে আলোচিত ইস্যুসমূহের মধ্যে একটি উদ্বেগ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কার্যকারণ ও ব্যাপক প্রভাব পুরো বিশ্বকে প্রতিনিয়ত ভাবিয়ে তুলছে। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীতে মানবসভ্যতা তথা জীববৈচিত্র্যের বাসযোগ্যতার চ্যালেঞ্জ ও পরিবেশ বিপর্যয়ের সমূহ ঝুঁকি। বলাই বাহুল্য, জলবায়ুর পরিবর্তনে উদ্ভূত এই বিরূপ পরিবেশ ঝুঁকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষের দ্বারাই তৈরি হয়েছে। প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে আমাদের অভিযোজন করতে পারাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজনের উপায় অনুসন্ধান করে নিচের আলোচনার দিকে মনোযোগ দিতে পারি।
সহজ ভাষায় অভিযোজন হলো পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে ও মানিয়ে নেওয়ার তথা নিজের অস্তিত্ব রক্ষা এবং বংশবৃদ্ধির জন্য পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জীবের অঙ্গ সংস্থানগত, শারীরিক ও আচরণগত পরিবর্তন।
অভিযোজন বিজ্ঞান এ পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অভিযোজনের তিনটি পর্যায় চিহ্নিত করেছে। প্রথম পর্যায়টি হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রতিকূল প্রভাবগুলো মূল্যায়ন করা এবং যাচাই করে দেখা যে আমরা আসলেই এমন কিছু করছি কি না, যা আমাদের সেই প্রভাবগুলোর জন্য আরো ঝুঁকির সম্মুখীন করে তুলছে। যদি তাই হয়, তাহলে আমাদের নিজেদের আরো ঝুঁকির সম্মুখীন করার প্রয়াস বন্ধ করতে হবে।
অভিযোজনের দ্বিতীয় পর্যায়টি হলো দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামোসমূহে বিনিয়োগ করার প্রবণতা তৈরি করা। এর অংশ হিসেবে সেতু, রাস্তা, বিমানবন্দর ও নৌবন্দরগুলোর বিষয় বিবেচনা করতে হবে, যাতে সেগুলো ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসহিষ্ণু হয়। এখন সারা বিশ্বে সব বড় অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও আমাদের তা বিবেচনা করতে হবে।
অভিযোজনের তৃতীয় পর্যায়টিকে রূপান্তরমূলক অভিযোজন বলা হয়, যা এখনো কিছুটা তাত্ত্বিক পর্যায়ে রয়েছে। এখনো তেমন উল্লেখযোগ্য নজির নেই। কেবল জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলোর ঝুঁকি মোকাবিলা নয়, বরং অভিযোজনব্যবস্থার ভালো ফল লাভের জন্যও এটি প্রযোজ্য।
বাংলাদেশ জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনার পথনকশা ২০১৫ সালে প্রণয়ন করে। বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলো প্রকৃতই রূপান্তরমূলক অভিযোজন অর্জনের লক্ষ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বেশ কিছুটা এগিয়েছে। অভিযোজনকে আরো কার্যকর করার বিষয়ে আমরা ইতিমধ্যে কিছু শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি।
সেই অভিজ্ঞতার আলোকে প্রথম শিক্ষাটি হচ্ছে সত্যিকারের রূপান্তরমূলক অভিযোজন অর্জনের জন্য এক দশক বা তারও বেশি সময় লাগবে। অতএব, স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি প্রকল্পভিত্তিক বিনিয়োগ এ ক্ষেত্রে ব্যবহারের উপযুক্ত হবে না। বৈশ্বিক তহবিল, যেমন—গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ) ব্যবহারের জন্য এটি একটি সমস্যা, যা শুধু প্রকল্পে অর্থায়ন করে থাকে। তারা যদি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় রূপান্তরমূলক অভিযোজন কর্মসূচিতে সহায়তা দিতে চায়, তাহলে তাদের দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচিভিত্তিক জাতীয় কর্মসূচিতে অর্থায়ন করতে হবে।
দ্বিতীয় শিক্ষাটি হচ্ছে সরকার ও সরকারের বাইরে বিশেষ করে বেসরকারি খাতসহ সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের সম্পৃক্ত করা। অর্থাত্, কেবল সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে গোটা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে সরে আসা। প্রকৃত রূপান্তরমূলক যে কোনো পরিবর্তনে অবশ্যই প্রতিটি দেশের সংশ্লিষ্ট সব অংশীদারকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তৃতীয় শিক্ষাটি হলো, রূপান্তরমূলক পরিবর্তনের মাত্রা হতে হবে দেশজুড়ে। তা কেবল কোনো ছোট অঞ্চলে বা খাতে সীমাবদ্ধ থাকবে না। তাই, এসব দেশে শুধু জাতীয় পর্যায়ে রূপান্তরমূলক অভিযোজন অর্জনের চিন্তা-ভাবনা ও পরিকল্পনা করতে হবে। মোটেও খাত পর্যায়ে নয়। ২০১১ সালের ১৭ অক্টোবর তারিখে ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবায় অনুষ্ঠিত স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) মন্ত্রীদের সাম্প্রতিক বৈঠকে জলবায়ু পরিবর্তনের রূপান্তরমূলক অভিযোজন অর্জন এবং জলবায়ু সহিষ্ণুতা অর্জনের মাধ্যমে এলডিসি অবস্থান থেকে উত্তরণের চেষ্টা করার একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। ২০০৮ সালে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা (বিসিসিএসএপি) প্রণয়ন করা হয়। ২০০৯ সালে তা সংশোধিত হয়। বাংলাদেশ প্রথম দেশ, যে এটি করেছে। চৌদ্দ বছর পর এখন এটি জনমুখী অংশগ্রহণের ভিত্তিতে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের দ্বারা হালনাগাদ করা প্রয়োজন। তাহলে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনার একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন দেখতে পাবে।
এটির মেয়াদ ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাড়ানো প্রয়োজন। সব জাতীয় পরিকল্পনার মূলধারায় জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার ওপর জোর দিতে হবে। এতে বাংলাদেশকে জলবায়ুসহিষ্ণু দেশে পরিণত করার জন্য রূপান্তরমূলক অভিযোজন অর্জনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। এসডিজিগুলোর সঙ্গে ডেলটা প্ল্যান এবং দেশের অষ্টম ও নবম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনকে সংযুক্ত করে সমগ্র সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জন করা দরকার। বদ্বীপ পরিকল্পনাটিকেও জনমতের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।
রূপান্তরমূলক অভিযোজন কেমন হতে পারে, তার একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। উপকূলবর্তী জেলাগুলোর লাখ লাখ মানুষকে অনিবার্য স্থানচ্যুতির বিষয়টি বিবেচনা ও প্রস্তুতির জন্য আমাদের উপকূল থেকে দূরে কয়েকটি শহরে বিনিয়োগ করতে হবে। যাতে এগুলো জলবায়ুসহিষ্ণু এবং অভিবাসী বন্ধুত্বপূর্ণ শহর হয়ে ওঠে, যেখানে কমপক্ষে ১ লাখ অভিবাসীকে স্থান দেওয়া যায়। উপকূলীয় এলাকার অল্প বয়সি ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দিতে হবে। দক্ষ করে তুলতে হবে, যাতে তারা তাদের পিতা-মাতার মতো কৃষক হওয়া ও মাছ ধরার পরিবর্তে শহরগুলোতে ভালো বেতনে কাজ করতে পারে। এই কৌশল রাজধানী ঢাকার ওপর চাপ কমাবে। এই মহানগরী আগামী দশকে আরো ১ কোটি জলবায়ু অভিবাসীর স্থান দিতে পারবে না। এটি বাংলাদেশকে রূপান্তরমূলক অভিযোজনের উদাহরণ হিসেবে আমাদের সব তরুণ ও ভবিষ্যতের নাগরিকদের অভিযোজন সক্ষমতা তৈরির সাফল্য এনে দেবে।
২০১৩ সালে বাংলাদেশ নিজস্ব বাজেটে জলবায়ু ট্রাস্ট তহবিল গঠন করেছে। এই তহবিল থেকে ইতিমধ্যে ৩ হাজার কোটি টাকার ওপরে নানা জলবায়ু কর্মসূচিতে বরাদ্দও দেওয়া হয়েছে। এছাড়া যুক্তরাজ্য ও কয়েকটি দেশসহ উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় জলবায়ু রেসাইলিয়েন্ট ফান্ড তৈরি করেছে। এখন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য জাতীয় বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কর্মসূচি নিতে হবে।
বরাদ্দ দিতে হবে জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা জেলাগুলোতে। সবুজ জলবায়ু তহবিল বা গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড, অ্যাডাপটেশন ফান্ড, এলডিসি ফান্ড এবং অন্যান্য বৈশ্বিক তহবিলগুলো থেকে অর্থায়ন পাওয়ার জন্য অভিযোজন ও প্রশমন কর্মসূচিগুলো প্রণয়ন ও পরিচালনার জন্য দক্ষতা ও সক্ষমতা তৈরি করা জরুরি দরকার। জরুরি ভিত্তিতে গবেষণা ও জ্ঞানভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ কার্যক্রম শুরু করা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এসংক্রান্ত এমফিল ও পিএইচডি কর্মসূচি অতিসত্বর চালু করা দরকার।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি থেকে বাংলাদেশ রূপান্তরমূলক অভিযোজন অর্জনের মাধ্যমে সর্বাধিক সহিষ্ণু দেশে রূপান্তরিত হতে পারে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের মতো বাংলাদেশ তাহলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ অর্জনেও সামনের কাতারের দেশে রূপান্তরিত হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী দেশ হিসেবে বিশ্বদরবারে নেতৃত্ব দিতে পারবে। সময় এখন আমাদের। সফল আমাদের হতেই হবে।