জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব শুধু আমাদের চোখের সামনেই ঘটছে না৷ যেমন অ্যান্টার্কটিকা ও দক্ষিণ আফ্রিকার মাঝে বিশাল মহাসাগরে যথেষ্ট খাদ্যের অভাবে একাধিক প্রজাতির তিমির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে৷
অ্যান্টার্কটিকা থেকে সাদার্ন রাইট তিমির ঝাঁক ফিরে এসেছে৷ প্রতিবার তাদের দেখা মেলা বিশেষ এক ঘটনা বটে৷ ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে গবেষকরা দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূলের কাছে আকাশে থেকে বাৎসরিক সমীক্ষা চালিয়ে আসছেন৷ তারা ছবি তুলে তিমির সংখ্যা গুনে সেগুলির স্বাস্থ্যের মূল্যায়ন করেন৷
গবেষকদলের বর্তমান প্রধান ভারময়লেন প্রবণতার দিকে কড়া নজর রাখছেন৷ তিনি বলেন, দক্ষিণের মহাসাগর ও অ্যান্টার্কটিক অঞ্চল কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রভাবিত হচ্ছে, আমরা রাইট হোয়েলকে তারই সূচক হিসেবে দেখি৷ এই তিমির ঝাঁক আসলে ইকোসিস্টেম পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূলের দিকে আসে৷ তাই আমরা তাদের রাইট হোয়েল বলি৷
গবেষকদের এই দল উপকূলের কাছে প্রায় কয়েকশো কিলোমিটার জুড়ে তিমির ছবি তোলে৷ বিশেষ করে তিমির মাথার ত্বকে সাদা ছোপ তাদের লক্ষ্য৷ সেই রুক্ষ ত্বক জুড়ে উকুনের স্তরই সাদা দেখায়৷ প্রত্যেকটি তিমির মাথায় সেই ক্যালোসিটির একেবারে নিজস্ব নক্সা দেখা যায়৷
কম্পিউটার মডেলিং ব্যবহার করে সেই প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করে নির্দিষ্ট প্রাণী শনাক্ত করা সম্ভব৷ তবে সেই ছবি তোলা বড় চ্যালেঞ্জ৷ হোয়েল ইউনিটের টেকনিকাল ম্যানেজার ক্রিস উইলকিনসন বলেন, আমাদের সরাসরি তিমির ঝাঁকের উপর থাকতে হয়৷ মাথার ঠিক উপর থেকে ক্যালোসিটি প্যাটার্নের স্পষ্ট ছবি তুলতে হয়৷ তিমির মাথার উপর সমুদ্রের ঢেউ থাকলে চলবে না৷ উড়ন্ত হেলিকপ্টারে সে চারিদিকে বাতাসের ধাক্কা সামলে সেই কাজ করা বেশ কঠিন চ্যালেঞ্জ৷
কেপ টাউন শহর থেকে দেড়শো কিলোমিটারের কম দূরত্বে ওয়াটার বে এলাকার অগভীর পানিতে অসংখ্য প্রাণী দেখা যায়৷ সাউদার্ন রাইট হোয়েল ছাড়াও হাম্পব্যাক তিমি সেখানে আসে৷ দক্ষিণ আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে তারা প্রতি বছর শাবক নিয়ে চলে আসে৷
মেরিন বায়োলজিস্ট হিসেবে জাস্টিন ব্লেক বলেন, ওয়াকার বে তিমির আশ্রয়স্থল৷ সারা বছর ধরেই সেটি মেরিন রিজার্ভ হিসেবে সুরক্ষা দেয়৷ জুন ও জুলাই মাসে সেখানে নৌকা চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়৷ এমন আশ্রয়স্থল থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই তিমিগুলিকে অনেক শক্তি ক্ষয় করে অ্যান্টার্কটিকা থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় আসতে হয়৷
শাবকের জন্ম দেওয়া, সদ্যোজাতদের জন্য মাতৃদুগ্ধ সৃষ্টি করা এবং অ্যান্টার্কটিকায় ফিরে যাওয়ার জন্য শরীরে যথেষ্ট শক্তি সংগ্রহ করা সহজ কাজ নয়৷ এই প্রাণীগুলির বিশ্রামের জায়গা সুরক্ষিত থাকলে নৌকা, জাহাজ বা অন্যান্য মানুষ এড়িয়ে যাবার জন্য বাড়তি শক্তি ক্ষয় করতে হয় না৷
১৯৭৬ সালে দক্ষিণ গোলার্ধে বাণিজ্যিক তিমি শিকার নিষিদ্ধ করার পর থেকে সেই প্রাণীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে৷ তবে গবেষকদের মতে, গোটা বিশ্বে তিমির সংখ্যা বাণিজ্যিক শিকারের আগের তুলনায় এখনো মাত্র ২০ শতাংশ ছুঁতে পেরেছে৷ সেই অঞ্চলে হারপুন বা তিমি শিকারের জাহাজ লুপ্ত হলেও কয়েক দশকের গবেষণা অনুযায়ী সাউদার্ন রাইট হোয়েল নতুন এক বিপদের মুখে পড়ছে৷
প্রিটোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ম্যানেজার ভারময়লেন বলেন, গবেষণা অনুযায়ী মাদী রাইট হোয়েলের শরীরের অবস্থা, ফ্যাটের অনুপাতের অনেক অবনতি ঘটেছে৷ ফলে শাবকদের মাতৃদুগ্ধ খাওয়ানোর ক্ষমতাও কমে গেছে৷ দক্ষিণ আফ্রিকার সাদার্ন রাইট প্রজাতি দক্ষিণ মহাসাগরে খাদ্য সংগ্রহ করে৷ আমরা সেখানে সমুদ্রে ভাসমান বরফের পরিমাণ কমে যেতে দেখছি৷ ফলে ক্রিলের বংশবৃদ্ধিও কমে যাচ্ছে, যা তিমির প্রধান খাদ্য৷ ফলে তিমির সংখ্যায় পরিবর্তন পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী নজরদারির গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে৷ সেইসঙ্গে তিমির জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশগত অবস্থারও তুলনা করা জরুরি৷
মানুষের বসতি থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে নাজুক এই ইকোসিস্টেমে চলমান পরিবর্তন তিমির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ সেখানকার মানুষের জন্যও এর গুরুত্ব কম নয়৷