কাউকে ব্যাংকের এমডি বা সিইও পদে নিয়োগ দিতে হলে তার কমপক্ষে ২০ বছরের অভিজ্ঞতা ও বয়স ন্যূনতম ৪৫ বছর হতে হবে, সেই সঙ্গে শিক্ষাগত যোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারণ প্রসঙ্গে নতুন কিছু শর্ত যোগ করা হয়েছে। একই সঙ্গে এই দুই পদের কর্মকর্তার বেতন-ভাতা ও অনুমোদিত সুবিধার বাইরে পরোক্ষ সব সুবিধা বাতিলের ঘোষণা দিয়ে নতুন নির্দেশনা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মঙ্গলবার জারি করা নির্দেশনায় এমডি ও সিইও হওয়ার নতুন মানদণ্ডের ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
নির্দেশনায় শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এমডি হিসেবে নিয়োগ পেতে স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ন্যূনতম স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী হতে হবে। অর্থনীতি, হিসাববিজ্ঞান, ফাইন্যান্স, ব্যাংকিং, ব্যবস্থাপনা কিংবা ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হবে। ডিজিটাল ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী নিয়োগের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা এমডি নিয়োগে অধিক গুরুত্ব পাবে।
শিক্ষাজীবনের কোনো পর্যায়ে তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণি থাকতে পারবে না জানিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশনায় বলেছে, গ্রেডিং পদ্ধতিতে এসএসসি বা সমমান ও এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষার ক্ষেত্রে জিপিএ ৩.০০-এর কম এবং অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রদত্ত সিজিপিএ-এর ক্ষেত্রে ৪.০০ পয়েন্ট স্কেলে ২.৫০-এর কম ও ৫.০০ পয়েন্ট স্কেলে ৩.০০-এর কম হলে, তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
বিদেশ থেকে ডিগ্রি অর্জনের ক্ষেত্রে প্রকাশিত ফলাফল (শ্রেণি/বিভাগ/জিপিএ) যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত হতে হবে বলেও জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে এসবের পাশাপাশি প্রার্থীর নেতৃত্ব দেয়ার গুণাবলী থাকতে হবে। এমডি পদে নিয়োগ হিসেবে কমপক্ষে ২০ বছরের অভিজ্ঞতাসহ ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার অব্যবহিত পূর্ববর্তী পদে কমপক্ষে দুই বছরের অভিজ্ঞতার বাধ্যবাধকতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে নতুন নির্দেশনায়।
তবে এসব যোগ্যতা থাকার পরেও কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ খেলাপি, পাওনাদারের প্রাপ্য পরিশোধ না করা, এমনকি আপস রফার মাধ্যমে পাওনা আদায় হতে অব্যাহতি লাভ করা ব্যক্তিও এমডি বা সিইও পদে নিয়োগের জন্য অযোগ্য বিবেচিত হবেন। পাশাপাশি আদালতের দেউলিয়া ঘোষিত হলে বা দায়িত্ব পালনকালে কোনোরূপ অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত হলেও তিনি অযোগ্য বিবেচিত হবেন।
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার নিয়োগের মেয়াদ হবে সাধারণত ৩ বছর। তবে তিনি পুনঃনিয়োগের যোগ্য হবেন। যে মেয়াদের জন্যই প্রস্তাব করা হোক না কেন, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রার্থীর সাক্ষাতকার নেওয়ার পর দেওয়া সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। একজন সিইও বা এমডি সর্বোচ্চ ৬৫ বছর পর্যন্ত এ পদে নিযুক্ত থাকতে পারবেন।
নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ফৌজদারি আদালতের দণ্ডিত, জাল-জালিয়াতি, আর্থিক অপরাধ বা অন্য কোনো অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে তিনি অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবেন। প্রার্থী সম্পর্কে কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলায় আদালতের রায়ে কোনো বিরূপ পর্যবেক্ষণ বা মন্তব্য থাকা যাবে না। পাশাপাশি কোনো নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের বিধিমালা, প্রবিধান বা নিয়ামাচার লঙ্ঘনজনিত কারণে দণ্ডিত হলেও প্রার্থী অযোগ্য বিবেচিত হবেন।
আরও বলা হয়েছে, কখনও এমন কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় যুক্ত ছিলেন বা আছেন, তার নিবন্ধন অথবা লাইসেন্স বাতিল বা অবসায়িত হয়েছে, এমন ব্যক্তি ব্যাংকের এমডি বা সিইও হতে পারবেন না। কিংবা কোনো কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হিসেবে যুক্ত ছিলেন, যার নিবন্ধন অথবা লাইসেন্স তার সরাসরি বা পরোক্ষ অপরাধজনিত কারণে বাতিল করা হলেও, সেই ব্যক্তি এমডি বা সিইও হতে পারবেন না।
এছাড়া অর্থ আত্মসাৎ, দুর্নীতি, জাল-জালিয়াতি ও নৈতিক স্খলনজনিত কারণে কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান বা পরিচালক বা কর্মকর্তা বা কর্মচারী থাকাকালীন স্বীয় পদ হতে অপসারণ, বরখাস্ত, বা অবনমিত হয়েছেন এমন ব্যক্তিকেও এমডি বা সিইও হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবে না ব্যাংক।
একইভাবে কোনো ব্যাংক-কোম্পানি বা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী বা চেয়ারম্যান বা পরিচালক বা কর্মকর্তা বা অন্য কোনো পদে আসীন থাকা অবস্থায় তাকে ওই পদ হতে অপসারণ, বরখাস্ত, বা অবনমিত করা হয়নি বা অব্যাহতি দেয়া হয়নি এমন ব্যক্তিকে এমডি বা সিইও পদে নিয়োগ দেওয়া যাবে। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের অফসাইট বা অনসাইট পরিদর্শনে কারও বিরুদ্ধে বিরূপ পর্যবেক্ষণ থাকলে তিনি এমডি হতে পারবেন না।
এর আগে এই পদে পদাধিকারীদের ন্যূনতম বয়স নিয়ে কোনো সীমারেখা ছিল না। পাশাপাশি অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে ১০ বছরই যথেষ্ট বলে গণ্য করা হতো।
যেসব সুবিধা কমছে
এদিকে নতুন নির্দেশনায় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) বেতন-ভাতা ও অনুমোদিত সুবিধার বাইরে পরোক্ষ সব সুবিধা বাতিল করা হয়েছে।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন জারি করা নির্দেশনায় বলা হয়েছে, এমডি ও সিইও বিদেশে চিকিৎসা খরচ বা বাৎসরিক মেডিকেল চেক-আপ বাবদ খরচ, বিদেশে পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা খরচ, ব্যক্তিগত ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিজের বা পরিবারের সদস্যদের বিদেশ ভ্রমণ ভাতা ব্যাংক থেকে নিতে পারবেন না। এখন থেকে এসব উচ্চ পদাধিকারীরা ব্যাংকের মুনাফার বিপরীতে কোনো লভ্যাংশ, কমিশন, ক্লাবের জন্য কোনো চাঁদা বা খরচের সুবিধা ব্যাংক থেকে নিতে পারবেন না।
তবে এমডি বা সিইওর যদি একান্তই নিজের চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে হয়, তাহলে চিকিৎসা গ্রহণের ক্ষেত্রে দেশের চিকিৎসা যথেষ্ট নয় মর্মে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রত্যয়নের ভিত্তিতে তিনি বিদেশে চিকিৎসা সুবিধা নিতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে বিদেশ বলতে কেবল এশিয়া মহাদেশের অন্তর্ভুক্ত যে কোনো দেশে অনুমোদন সাপেক্ষে ব্যাংক থেকে চিকিৎসা ভাতার সুবিধা নিতে পারবেন।
নতুন নির্দেশনায় বলা হয়েছে, এসব পদাধিকারীর উৎসাহ বোনাস বছরে ১৫ লাখ টাকার বেশি হবে না। ব্যাংকের অন্য কোনো কর্মকর্তা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার জন্য নির্ধারিত সীমার বেশি উৎসাহ বোনাস পাবেন না। এ ছাড়া বছরে দুটির বেশি উৎসাহ বোনাস দেয়া যাবে না এবং কোনো উৎসাহ বোনাস মূল বেতনের বেশি হবে না। এ ছাড়া ইউটিলিটি বিল, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার নিজের চিকিৎসা খরচ, ইনস্যুরেন্স প্রিমিয়ামের সুনির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখতে হবে। তা ছাড়া এখন থেকে এমডি ও সিইওদের ব্যক্তিগত গাড়ি, জ্বালানি ও চালক সুবিধার মাসিক অর্থমূল্য বেতন-ভাতায় উল্লেখ করতে হবে। পাশাপাশি এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ব্যাংক থেকে নেওয়া সব ধরনের সুবিধার বর্ণনা চুক্তিপত্রে উল্লেখ করতে হবে এবং প্রতিমাসে বেতনের সময় এসব সুবিধার অর্থমূল্যের হিসাব সংরক্ষণ রাখতে হবে।
এমডি ও সিইওর বেতন-ভাতা নির্ধারণ হবে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা, কর্মকাণ্ডের ব্যাপকতা, ব্যবসার পরিমাণ, উপার্জন ক্ষমতা, শাখা, উপশাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং ও আঞ্চলিক কার্যালয়ের সংখ্যা বিবেচনায়। এ ছাড়া এখন থেকে বেতন-ভাতার বিপরীতে আয়কর এমডি বা সিইও নিজ উৎস থেকে দেবেন।
এর বাইরে বিদেশে চিকিৎসা খরচ বা বাৎসরিক মেডিকেল চেকআপ বাবদ খরচ, বিদেশে পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা খরচ, ব্যক্তিগত ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিজের বা পরিবারের সদস্যদের বিদেশ ভ্রমণ ভাতাও ব্যাংক থেকে নিতে পারবেন না বলে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।