মানবদেহের খুবই জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ মস্তিষ্ক। শরীরের যেকোনো অংশে আঘাত বা স্পর্শ সবার আগে অনুধাবন করে মস্তিষ্ক। একই সঙ্গে কথা বলা বা চিন্তা করা থেকে শুরু করে শরীরের যেকোনো অংশের কাজের ক্ষেত্রে সবার আগে যে অংশ কাজ করে, সেটি হচ্ছে মস্তিষ্ক।
মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা যার যত বেশি, তিনি তত স্বল্প সময়ে মেধাভিত্তিক কাজে এগিয়ে থাকেন। তিনি অল্প সময়ে কাজে সফল হয়ে থাকেন। প্রয়োজন শুধু একটু চর্চার। কিন্ত এমন অনেকেই আছেন যারা নানাভাবে মস্তিষ্কের ক্ষতি করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল, ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউরোলজিক্যাল ডিজঅডার্স অ্যান্ড স্ট্রোকসহ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এ ব্যাপারে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা। এবার তাহলে মস্তিস্কের ক্ষতি করে এমন কয়েকটি কাজ ও অভ্যাস সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
অপর্যাপ্ত ঘুম: অপর্যাপ্ত ঘুমের কারণে মস্তিষ্কের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রিমিয়ার নিউরোলজি অ্যান্ড ওয়েলনেস সেন্টার এ তথ্য জানিয়েছে। আরও জানানো হয়েছে, প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমকে পর্যাপ্ত ঘুম বোঝানো হয়। এ জন্য রাতে নিরবচ্ছিন্ন ঘুম বেশি কার্যকর। ঘুমানোর সময় মস্তিষ্ক বিশ্রাম নেয়। পাশাপাশি বিষাক্ত পদার্থ পরিষ্কার করে এবং নতুন করে কোষ তৈরি করে। তবে ৭ ঘণ্টার কম যদি ঘুম হয়, তাহলে নতুন কোষ গঠন হয় না।
এসব কারণে কিছু মনে রাখা সম্ভব হয় না, মনোযোগ দিতেও কষ্ট হয়। আবার মেজাজ খিটখিটে হওয়া, সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা এবং ডিমেনশিয়া অ্যালঝেইমার্সের ঝুঁকিও থাকে। মস্তিষ্ক ভালো রাখতে পর্যাপ্ত ঘুমের জন্য পরিবেশ তৈরি করতে হবে এবং প্রতিদিন নিয়ম করে ঘুমাতে হবে। তবে মাথা ঢেকে ঘুমানো যাবে না। এতে শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হতে পারে।
সকালের নাশতা না করা: সারা রাত না খেয়ে থাকার পর সকালে কাজের সময় শক্তি আসে সকালের নাশতা থেকে। কিন্তু এমন অনেকেই আছেন যারা সকালে তাড়াহুড়োর জন্য নাশতাই করেন না। সকালে নাশতা না করার কারণে রক্তে শর্করার মাত্রা হ্রাস পায়। যা সরাসরি মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে। এভাবে ক্রমশ চলতে থাকলে মস্তিষ্কের ক্ষয় হয়, কোষগুলো কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে।
পর্যাপ্ত পানি পান না করা: মানবদেহের মস্তিষ্কের ৭৫ শতাংশিই পানি। এ জন্য মস্তিষ্কের ভালো কাজের জন্য একে আর্দ্র রাখা অনেক বেশি প্রয়োজন। পানির অভাবে মস্তিস্কের টিস্যু সংকুচিত হওয়া ও কোষগুলো কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এতে যৌক্তিক যুক্তিসংগত চিন্তা বা সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো ক্ষমতা দিন দিন কমে যেতে পারে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দিনে অন্তত দুই লিটার পানি পান করা উচিত। তবে স্বাস্থ্য, বয়স, লাইফস্টাইল ও আবহাওয়ার ওপর ভিত্তি করে এর পরিমাণ কম-বেশি হতে পারে।
অতিরিক্ত চাপ ও শুয়ে বসে থাকা: দীর্ঘক্ষণ যদি অনেক চাপে কাজ করা হয় তাহলে মস্তিষ্কের কোষ মারা যায় এবং সামনে থাকা ফ্রন্টাল কর্টেক্স সংকুচিত হতে থাকে। ফলে স্মৃতি ও চিন্তাশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ব্যাপারে গবেষকদের মতামত, কাজেরে ক্ষেত্রে যারা খুবই খুঁতখুঁতে, যারা অন্যের সহযোগিতায় ভরসা খুঁজে পান না, আবার যারা কাউকে ‘না’ বলতে পারেন না, তারা সবচেয়ে মানসিক চাপে ভোগেন। তাই যেকোনো পরিস্থিতিতে বেশি চাপ নেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
অনেকেই আছেন অসুস্থ হলেও ওই অবস্থায় মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করে কাজ করেন। যা একদমই উচিত নয়। কারণ, শরীর অসুস্থ থাকলে মস্তিষ্ক রোগ প্রতিরোধে ব্যস্ত থাকে। এ জন্য মস্তিষ্ককে বেশি চাপ না দিয়ে বরং বিশ্রামে রাখা উচিত। অন্যাথায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে মস্তিষ্কে।
আবার এমন কিছু কাজ রয়েছে যেখানে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে হয়। তারা ছুটির দিন এলে শুয়ে বসে কাটিয়ে দেন। যথেষ্ট নড়াচড়া বা চলাফেরা কিংবা শারীরিক পরিশ্রম করেন না। এ থেকে ওজন বেড়ে যাওয়া, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এমনকি ডিমেনশিয়াও হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ জন্য নিয়মিত শরীরচর্চা করা উচিত।
গুগল সার্চ: এমন অনেকেই আছেন যারা ছোটোখাটো হিসাব ক্যালকুলেটর ছাড়াই করে ফেলেন। আবার অনেক আত্মীয়-স্বজনের ফোন নম্বর মুখস্থ থাকে তাদের। মূলত অনেক বই পড়ার কারণে সাধারণ জ্ঞান সমৃদ্ধ হয়। এসব চর্চা আসলে মস্তিষ্কের ব্যায়ামের মতো। এতে চিন্তাশক্তি ও স্মরণশক্তি দীর্ঘায়িত হয়। কিন্তু এখন অনেকেই যেকোনো প্রয়োজনে প্রযুক্তিনির্ভর। কিছু হলেই মস্তিষ্ক না খাটিয়ে অনলাইনে গিয়ে সার্চ করেন। অনলাইন থেকে পরামর্শ নেন। গবেষকরা এসব বাদ দিয়ে মস্তিষ্ক শাণিত করার জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
হেডফোন বা উচ্চ শব্দে গান শোনা: হেডফোন বা এয়ারপড ৩০ মিনিটেরও কম সময়ে শ্রবণশক্তির ক্ষতি করতে পারে। একই সঙ্গে উচ্চ শব্দে গান শোনার ফলে উচ্চ শব্দের মধ্যে থাকলে শ্রবণের ক্ষতি হয়ে থাকে। আর শ্রবণশক্তি যদি একবার ক্ষতি হয়, তাহলে আর ঠিক করা যায় না। শ্রবণশক্তি কমে গেলে মস্তিষ্কে সরাসরি প্রভাব পড়ে। যদি কখনো গান শুনতে হয়, তাহলে কখনোই ৬০ শতাংশের বেশি ভলিউম বাড়াবেন না। আর দীর্ঘক্ষণ হেডফোন ব্যবহারও করবেন না। প্রয়োজন হলে মাঝে এক ঘণ্টা বিরতি নিয়ে নিন।
একাকীক্ত ও সামাজিক না হওয়া: আশপাশে থাকা মানুষের সঙ্গে কথা বলা, আড্ডা দেয়া, অর্থাৎ সামাজিক হতে হবে। যা মস্তিষ্কের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। কখনো দীর্ঘ সময় একা থাকা যাবে না। এতে মস্তিস্কে খারাপ প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা থাকে, যতটা থাকে পর্যাপ্ত ঘুম না হলে। একাকীত্ব থেকে বিষণ্নতা, উদ্বেগ ভর করে থাকে আমাদের। এমনকী ডিমেনশিয়া ও আলঝেইমার্স রোগেরও আশঙ্কা থাকে একাকীত্ব থেকে। এ জন্য সামাজিক হওয়া জরুরি।
নেতিবাচক হওয়া: কিছু মানুষ রয়েছে যারা সবসময় নেতিবাচক চিন্তা করেন বা এমন অভ্যাস থাকে। যেমন, তোমাকে দিয়ে এটা হবে না, দেশের অবস্থা ভালো না, তোমার ভবিষ্যৎ খারাপ, তুমি হতভাগাসহ এমন নানা নেতিবাচক কথা বলেন। এসব চিন্তা মস্তিস্কে প্রভাব ফেলে। কারণ, নেতিবাচক চিন্তার ফলে হতাশা ও উদ্বিগ্নতা দেখা দেয়। একইভাবে মস্তিস্কে অনেক অ্যামাইলয়েড ও টাউ জমে। এসব হচ্ছে ডিমেনশিয়া ও আলেঝেইমার্সের লক্ষণ। তাই নেতিবাচক চিন্তা বা অভ্যাস বাদ দিতে হবে। প্রয়োজনে মনোরোগবিদের সহায়তা নিতে পারেন।
অন্ধকারে থাকা: মার্কিন এক গবেষণায় দেখা গেছে, অন্ধকারে বেশি সময় কাটানো বা দীর্ঘসময় আবদ্ধ কোথাও যারা থাকেন, বাতাসে চলাচল করেন না―এমন পরিবেশে যারা থাকেন তাদের মস্তিষ্কে অনেক চাপ তৈরি হয়। কারণ, মস্তিস্কের জন্য সূর্যের আলো অনেক বেশি জরুরি। তা না হলে ডিপ্রেশনের মতো নানা সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মস্তিষ্ক সুস্থ রাখার জন্য প্রতিদিন সূর্যের আলো প্রয়োজন। প্রতিদিন কিছুক্ষণের জন্য হলেও সূর্যের আলোয় থাকা চাই। পাশাপাশি ঘরের দরজা-জানালা খোলা রাখুন। এতে বাইরে থেকে আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারবে ঘরের ভেতরে।