মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীদের জন্য শীতকাল মানে ট্যুরের উপযুক্ত সময়। অনেকেই এ সময় দূরদূরান্তে ছুটে যান প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে। আবার কেউ ছুটে যান খেজুরের রস কিংবা শীতের পিঠা খেতে। তবে তীব্র শীত আরও কুয়াশার কারণে প্রায়ই বিড়াম্বনায় পড়তে হয় রাইডারদের।
রাইডারই লং ট্যুরের প্রতি আসক্ত হলেও এই লং ট্যুরের ক্ষেত্রে কী কী প্রস্তুতি থাকা দরকার সেটাই জানেন না অনেকে। এই ট্যুরগুলো নিরাপদভাবে ও ঝামেলা মুক্তভাবে করতে পারেন তখনই এটা আপনার কাছে আরও উপভোগ্য হয়ে ওঠে। আর একটা পারফেক্ট প্ল্যান এবং প্রস্তুতির মাধ্যমেই আপনি এই ট্যুর আরও উপভোগ করতে পারেন।
চলুন জেনে নেয়া যাক লং ট্যুরে যাওয়ার আগে কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন-
বাস্তবসম্মত ট্যুর প্ল্যান
বাইকে করে লম্বা ট্যুর দেয়ার জন্য কোথায় যাচ্ছেন, সেই অনুযায়ী দিনে কতটুকু পথ পাড়ি দিতে হবে, মাইলেজের হিসাব, কতবার, কোথায় থামতে হবে, কোথায় রাত কাটাবেন, খাবেন, তেল ভরবেন এ সবকিছুর একটা বিস্তারিত প্ল্যান রেডি করে ফেলতে হবে।
তবে আবহাওয়া, ট্র্যাফিক সমস্যা কিংবা কোনো জরুরি অবস্থার কারণে অনেক সময়ই প্ল্যানে পরিবর্তন আসতে পারে। তাই যে কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার মনোভাব নিয়েই ট্যুর প্ল্যান করতে হবে।
অন্য রাইডারদের সঙ্গে বের হলে তাদের সঙ্গে যেকোনো জরুরি অবস্থায় পরামর্শ করে চলতে হবে। দিনশেষে বিশ্রাম নেয়ার সময় পরের দিনের মাইলেজ ও গ্যাস স্টেশন ইত্যাদি বিস্তারিত প্ল্যান তৈরি করে নেয়া উচিত।
বাইক সার্ভিসিং করানো জরুরি
লং রাইডে যাওয়ার আগে অবশ্যই অভিজ্ঞ মেকানিক দিয়ে বাইক সার্ভিসিং করিয়ে নিতে হবে। নিরাপত্তা নির্ভর করবে বাইক সার্ভিসিং করার ওপরে। দীর্ঘ একটি বাইক জার্নিতে হঠাৎ আপনার বাইকের ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যেতে পারে, তেল শেষ হয়ে যেতে পারে, স্পার্ক প্লাগ কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে কিংবা টায়ার পাংচার হতে পারে।
এ রকম নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন রাস্তার মধ্যে। বাইকে আগে থেকে সমস্যা থাকলে লং রাইডে যাওয়ার সময় এ রকম বিপদে পড়তে হয়। বাইকের প্রতিটি অটো পার্টস সচল আছে কি না তা লং রাইডে যাবার আগে পরীক্ষা করা উচিত। এতে আপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও বাড়তি পার্টস সঙ্গে রাখুন
ট্যুরে যাওয়ার আগে একজন দক্ষ মেকানিক দিয়ে আপনার বাইক সার্ভিসিং করানোর সময় তার কাছ থেকে জেনে নিন কী কী সরঞ্জাম ট্যুরে সঙ্গে নেয়া দরকার হবে। সেই অনুযায়ী প্যাকিং করুন। প্রত্যেকটি বাইকের চাহিদা আলাদা। তবে সাধারণভাবে যেইসব জিনিস সবারই লাগে, সেগুলো হচ্ছে- বাড়তি টিউব, স্পার্ক প্লাগ, ব্রেক ও এক্সেলেটরের তার, ইঞ্জিন অয়েল ইত্যাদি।
বাইক নির্বাচন বা মডিফিকেশন
নিজস্ব বাইক না থাকলে, বা ট্যুর-উপযোগী না হলে; এমন একটি বাইক বাছাই করে নিন, যেটাতে আপনি সবসময় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন, আবার সেটা লম্বা দূরত্ব পারি দেয়ার মতো শক্তিশালীও হতে হবে। নিজের বাইক থাকলে সুবিধা ও প্রয়োজন অনুযায়ী বাইক মডিফিকেশন করিয়ে নিন।
সাধারণত বাইকাররা লং ট্যুরের আগে যেসব মডিফিকেশন করিয়ে থাকেন- হ্যান্ডেল-বার বদল, আরও আরামদায়ক সিট, গার্ডস, ভালো হেডলাইট, নতুন এক্সহস্ট পাইপ ইত্যাদি।
প্রয়োজনীয় কাগজ
লং ট্যুরে মোটরসাইকেল ও নিজের সব জরুরি নথি সঙ্গে রাখুন। টোল প্লাজাতে অযাতিচ সমস্যার হাত থেকে রক্ষা পেতে সব কাগজ সঙ্গে রেখে দিন।
রাইডের আগে আবহাওয়া চেক করুন
শীতকালে বা বর্ষাকালে রাইডে বের হওয়ার আগে অবশ্যই আবহাওয়া চেক করতে হবে। কুয়াশায় বা বৃষ্টিতে রাইডিংয়ের সময় বেশি সতর্ক থাকুন। কুয়াশার কারণে দেখতে সমস্যা হলে কোথাও দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। আর বৃষ্টির সময় যথাসম্ভব বাইক চালানো থেকে বিরত থাকুন।
ভালো মানের হেলমেট পড়ুন
শীতকালে শিশির ও বর্ষকালে বৃষ্টির কারণে বাইক স্লিপ কাটার আশঙ্কা বেড়ে যায়। তাই চালক এবং পিলিওন উভয়কেই ভালো মানের হেলমেট পরিধান করতে হবে। সম্ভব হলে একজনের বেশি পিলিওন না নেয়াই উচিত। কারণ এতে দুর্ঘটনার পাশাপাশি মামলা খাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
অতিরিক্ত গতি হতে পারে মৃত্যুর কারণ
শীতকালে শিশির ও বর্ষকালে বৃষ্টির মধ্যে অতিরিক্ত গতির জন্য অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, অতিরিক্ত গতি জীবন পুরাটাই নষ্ট করে দিতে পারে। তাই বাইকের গতি নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখুন। পাশাপাশি গতিসীমা মেনে চলুন।
রাইডের আগে ব্রেক চেক করুন
মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্রেকিং সিস্টেম। শীতকালে ঘন কুয়াশার মধ্যে কয়েক হাত দূরের বস্তুও দেখা যায় না। তাই হঠাৎ করেই ব্রেক করার প্রয়োজন হতে পারে। এজন্য রাস্তায় বের হবার আগে উভয় ব্রেক ঠিকমতো কাজ করছে কিনা দেখুন।
এ ছাড়া হুটহাট ব্রেক করা থেকে বিরত থাকুন। ব্রেক করার জন্য নিরাপদ দূরত্ব রেখে রাইড করুন। রাস্তায় অন্যান্য যানবাহনের সঙ্গে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি দূরত্ব রাখুন।
ঘন ঘন লুকিং গ্লাস দেখুন
বাইক চালানোর সময় সবসময় লুকিং গ্লাসে নজর রাখাটা জরুরি। গাড়ির পেছনের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য প্রতিমিনিটে ৬ থেকে ৮ বার লুকিং গ্লাস দেখতে হয়।
সঠিক পোশাক ও এক্সেসরিজ
দূরপথে রাইডিংয়ের জন্য সবসময় চেষ্টা করুন রাইডিং প্যান্ট, গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা বুট জুতা, রাইডিং জ্যাকেট এবং অবশ্যই একটি সম্পূর্ণ মুখ ঢাকা হেলমেট পরিধান করতে। অথবা সাধারণ পোশাকের সঙ্গে কনুই ও হাটুর গার্ড, বডি আর্মর বা বর্ম পরেও চালানো যায়।
বাইক চালানোর জন্য কিছুটা আঁটসাঁট বা ফিটিং পোশাক হলে সুবিধা হয়। এইসব পোশাক ও এক্সেসরিজ আপনাকে নিরাপদ রাখবে।
পর্যাপ্ত তেল নিন
ট্রিপ শুরু করার আগে বাইকের ট্যাংকি ভর্তি করে নিন। ফলে নিয়মিত পেট্রোল পাম্প খোঁজার ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবেন। এ ছাড়াও যাত্রা শুরুর আগে ট্রিপ মিটার রিসেট করে নিন। এর মাধ্যমে আপনি ঠিক কত কিলোমিটার চললেন তা জানতে পারবেন।
বিরতি নিতে হবে
লং ট্যুরের ক্ষেত্রে অবশ্যই যাত্রাপথে নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর বিরতি নিতে হবে। কারণ বাইক এবং শরীর দুটোরই বিশ্রামের প্রয়োজন রয়েছে। তাই নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর ভালো জায়গা থেকে বিরতি নেয়ার চেষ্টা করুন।
বিরতির সময় মোটরসাইকেলের চাকা ও ইঞ্জিন অয়েলসহ অটো পার্টস চেক করে নিন। সম্ভব হলে পানি ও হালকা নাস্তা খেয়ে নিন। তবে বারবার থামতে গেলে যাত্রাপথে অনেক সময় নষ্ট হবে, আর গন্ত্যবে সময়মতো পৌঁছাতে কষ্ট হবে।
পর্যাপ্ত পানি পান করুন
লং ট্যুরের সময় পানিশূন্যতা অনেক ভয়াবহ সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। প্যাকিং করার সময় সঙ্গে ভালো পানির বোতল বা ফ্লাস্ক নিতে ভুলবেন না। কোথাও বিরতি নিলে বোতল মনে করে রিফিল করে নিতে হবে।
নাস্তা, দুপুরের খাবার, এইসব পরিমিত পরিমাণে খান। বেশি খাবার খেয়ে ফেললে সেগুলো হজম করতে অনেক এনার্জি খরচ হয়ে যায়, আর ক্লান্তি এসে ভর করে। তাই যতক্ষণ না গন্তব্যে পৌঁছাবেন, খাওয়াদাওয়া সীমিত রাখুন; স্বাস্থ্যকর খাবার খান।
এতে করে বারবার ওয়াশরুম ব্যবহার করার ঝামেলা, আর ফুড পয়জনিংয়ের ভয় থাকবে না।তবে এসব জিনিসের বাইরেও আপনার প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন জিনিস সঙ্গে রাখতে পারেন বা নিয়ম-কানুন মেনে চলতে পারেন।