দেশের আকাশে হিজরি শাবান মাসের চাঁদ দেখা গেছে। আগামী ১২ অথবা ১৩ মার্চ শুরু হতে পারে ২০২৪ সালের রমজান মাস। এ মাসে রোজাদারদের জন্য ইফতারের প্রধান আইটেম খেজুর। ধনী-গরিব সবাই একটা হলেও খেজুর দিয়ে ইফতার করতে চেষ্টা করে। এরই মধ্যে বাজার থেকে খেজুর উধাও। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাড়তি শুল্কের কারণে খেজুর আমদানি করা যাচ্ছে না।
জানা গেছে, পাইকারি বাজারে গত বছর রোজায় ৯০-১১০ টাকা দরের খেজুর এবার ১৪০-১৫০ টাকা, ১২০-১৩০ টাকার খেজুর ২৫০ টাকারও বেশি, ২০০ টাকার খেজুর ৪০০ টাকার বেশি এবং ৩০০-৩৫০ টাকার খেজুর ৬০০ টাকার বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
মঙ্গলবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) আতিকুর রহমান রাজধানীর চকবাজারে তিনটি দোকানে দরদাম করলেন। কিন্তু খেজুর কিনলেন না। এ বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, দুই মাসের ব্যবধানে খেজুরের দাম কেজিতে ২০০টাকা বেড়েছে। খেজুর কেনার জন্য যে টাকা এনেছিলাম তা যথেষ্ট নয়। এ জন্য খেজুর কেনা হলো না।
খেজুর বিক্রেতা মকসুদ মোল্লা বলেন, গত ২ মাসে হাজার টাকার নিচের খেজুরের দাম কেজিতে ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। আমাদের ক্রেতা ছাড়তে ইচ্ছে করেনা। দাম বাড়ায় এক কার্টন খেজুর বিক্রি করতে আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ সময় লেগে যাচ্ছে।
এদিন রাজধানীর পাইকারি বাজার বাদামতলীতে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় সবগুলো দোকান খেজুর শূন্য। হাতে গোনা কয়েকটিতে খেজুরের কার্টন সাজানো। সেখানে ভিড় জমাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন তারা কবে খেজুর পাবেন?
এ বিষয়ে পাইকারি দোকান সাফওয়ানা ফ্রুটস ট্রেডিং করপোরেশনের মালিক ও বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফআইএ) সভাপতি সিরাজুল ইসলাম জানান, আমার দোকানে খেজুর নেই বললেই চলে। অতিরিক্ত শুল্কের কারণে খেজুর আমদানিও করতে পারছি না।
আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, গত রমাজানে যে খেজুর পাইকারি বাজারে ২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে, এবার সেই খেজুরের ওপরই আমদানি শুল্ক গুনতে হচ্ছে ২০৮ টাকা। এতে পাইকারি বাজারেই খেজুরটির দাম দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে গেছে।
এদিকে সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) সংবাদ সম্মেলনে বিএফএফআইএ নেতারা দাবি করেন, খেজুরের দাম বাড়ার কারণ কাস্টমসের শুল্কায়নের অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু নির্ধারণ। তারা এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক বাজারের দাম অনুযায়ী শুল্কায়ন করার দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমরা ইরাক থেকে কার্টুনে ৮০০-৯০০ ডলারে যে খেজুর আমদানি করছি, সেটার অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫০০ ডলারে। প্রায় তিন গুণ বেশি দাম দেখিয়ে যে খেজুরটার শুল্ক নেওয়া হচ্ছে। এটি কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। কাস্টমস আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণ ও আমাদের সঙ্গে কথা বলে প্রকৃত দামের ওপর অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু নির্ধারণ করুক, এটাই আমরা চাই। না হলে খেজুরের দাম দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। দামের কারণে মানুষও খেজুর কিনতে পারছে না।
তিনি বলেন, প্রতি বছর রোজায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি খেজুরের চাহিদা রয়েছে। সে অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা রোজার আগে বাড়তি খেজুর আমদানি করেছে। এবারও ইতোমধ্যে প্রায় ১০ হাজার মেট্রিক টন খেজুর আমদানি হয়েছে এবং শুল্কায়নের অপেক্ষায় ৪০০-৫০০ কন্টেইনার খেজুর বন্দরে আটকে আছে, যেখানে ১৫ হাজার মেট্রিক টনের বেশি খেজুর রয়েছে। বাড়তি অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালুর কারণে এই খেজুরগুলো ব্যবসায়ীরা ছাড়াচ্ছে না। আর নতুন করে আমদানিও করতে চাচ্ছে না।
বিএফএফআইএ সভাপতি বলেন, বাজারে ইতোমধ্যেই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যা রোজায় আরও বাড়তে পারে। নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষগুলো এবার খেজুর কিনতে পারবে কি না তা নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এই অবস্থার নিরসনের একমাত্র উপায় প্রকৃত দামে অ্যাসেমেন্ট ভ্যালু নির্ধারণ করা।
তিনি বলেন, প্রকৃত দামের ওপর অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু নির্ধারণ না করার কারণে আমদানিকারকদের অযৌক্তিকভাবে শুল্ক পরিশোধ করতে হচ্ছে। গত রোজার আগে মানভেদে প্রতি কেজি খেজুরে যেখানে শুল্ক দিতে হতো ৫.৪৫ টাকা থেকে ২১.৮৪ টাকা, সেটি এবার দাঁড়িয়েছে ৫৪ টাকা থেকে ২০৮ টাকা।
ব্যবসায়ীদের দাবি, গত ৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড খেজুরের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে। কিন্তু এতেও খরচের খুব বেশি হেরফের হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতি মেট্রিক টন খেজুর ৫০০-১৩০০ ডলার দিয়ে কিনে দেশের তার অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু ধরা হয়েছে ক্যাটাগরি ভেদে ১০০০-২৭৫০ ডলার। অর্থাৎ প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বেশি দাম ধরে শুল্ক আদায় করছে কাস্টমস।
কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, খেজুর আমদানিতে ব্যবসায়ীদের কাস্টমস শুল্কসহ মোট ৫৩ শতাংশের মতো বিভিন্ন শুল্ককর দিতে হচ্ছে। সেগুলো হচ্ছে- কাস্টমস শুল্ক ২৫ শতাংশ, রেগুলেটরি ডিউটি ৩ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর ৫ শতাংশ এবং অগ্রিম কর ৫ শতাংশ।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আইনুল ইসলাম বলেন, বিগত রমজানে ৬-৭টা আইটেমের ওপর কড়া নজরদারি থাকত। এবার রমজানের অনেক আগেই জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় মানুষ কষ্টে আছে। যদি রমজানে পণ্যের দাম বাড়ে, তাহলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে। অথচ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারেই দ্রব্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার কথা বলা হয়েছে।