গণপরিবহনের ধাক্কাধাক্কি এবং যানজট থেকে রেহাই পেতে বাংলাদেশের মানুষের মাঝে ব্যক্তিগত গাড়ি ক্রয়ের প্রবণতা বেড়ে গিয়েছে। নতুন গাড়ি ক্রয়ের সময় অনেকেই জ্বালানি খরচের কথা মাথায় রাখেন না। তাই নতুন গাড়ি মালিকদের মাঝে জ্বালানি খরচজনিত সমস্যায় পড়া একটি কমন সমস্যা। অসাবধানতার কারণে জ্বালানি খরচ এতোটাই বেড়ে যায় যে ব্যক্তিগত গাড়ির মাধ্যমে যাতায়াত অনেক কঠিন হয়ে পরে।যাতে করে আপনি নির্বিঘ্নে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন এবং জ্বালানি খরচজনিত সমস্যা এড়িয়ে চলতে পারেন।
১. এগ্রেসিভ ড্রাইভিং করা যাবে না
এগ্রেসিভ ড্রাইভিং করার মাধ্যমে জ্বালানি খরচ অনেক বেড়ে যেতে পারে। যেমন – অতিরিক্ত গতি, দ্রুত এক্সেলেরেশন, খুব জোড়ে ব্রেক করা, ঘন ঘন লেন চেঞ্জ করা এবং খুব দ্রুত টার্ন নেয়া ইত্যাদি বিষয় এগ্রেসিভ ড্রাইভিং-এর উদাহরণ। ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নেয়ার সময় থেকেই এগ্রেসিভ ড্রাইভিং পরিহার করার প্র্যাক্টিস করা উচিত।
রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় ড্রাইভারদের মাথা পুরোপুরি ঠান্ডা রেখে গাড়ি চালানো প্রয়োজন। মনে রাখবেন, মাথা গরম করে এগ্রেসিভ ড্রাইভিং করলে আপনার ফুয়েল খরচ বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি আপনার দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার সম্ভাবনাও কিন্তু বেড়ে যাবে।
২. টেলিম্যাটিক্স সেবা গ্রহণ করুন
একটি জিপিএস ফ্লিট ট্র্যাকিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে কিন্তু আপনি আপনার গাড়ির পারফরম্যান্স সম্পর্কে জানতে পারবেন এবং একই সাথে ড্রাইভারের সেফটি মেইনটেইন করতে পারবেন। এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে আপনি গাড়ির ব্যবহৃত রুট, ফুয়েল কনজাম্পশন ছাড়াও আরো অনেক তথ্য জানতে পারবেন। আপনার অতিরিক্ত ফুয়েল খরচ হচ্ছে কি না, আর হলে তা কেনো হচ্ছে সেই সম্পর্কে ক্লিয়ার ডেটা পেতে এই ধরণের সেবা অনেক কাজে লাগে।
৩. চাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে হাওয়া রাখুন
টায়ারে পর্যাপ্ত পরিমাণে হাওয়া না থাকলে প্রেশার কমে যায়। যার কারণে গাড়ি তার পূর্ণ গতিতে চলতে পারে না। ফলে কম দুরুত্ব অতিক্রম করতে বেশি জ্বালানি খরচ হয়ে যায়। অপরদিকে, চাকায় পর্যাপ্ত হাওয়া থাকলে তা গাড়িকে পূর্ণ গতিতে চলতে সাহায্য করে। তবে গরম ও শীতকালে টায়ারের প্রেশার ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। তাই শীতকালে আপনি টায়ারে যতোটুকু প্রেশার রাখেন, তা গরমকালের জন্য পর্যাপ্ত না’ও হতে পারে। তাই নিয়মিতভাবে টায়ারের প্রেশার চেক করে তা এফিশিয়েন্ট লেভেলে রাখা প্রয়োজন।
৪. অক্সিজেন সেন্সর চেক করুন
১৯৮০ সাল পরবর্তী সময়ে যতো গাড়ি ম্যানুফ্যাকচার করা হয়েছে সবগুলোর ভেতরেই একটি করে বিল্ট-ইন অক্সিজেন সেন্সর থাকে। অক্সিজেন সেন্সর গাড়ির এক্সস্ট গ্যাসে অক্সিজেনের পরিমাণ নোট করে এবং সেই ডেটা ইঞ্জিনে পাঠায় যাতে করে ইঞ্জিন বুঝতে পারে যে পরবর্তী কম্বাশ্চন সাইকেলে কি পরিমাণ ফুয়েল প্রয়োজন হবে। অক্সিজেন সেন্সর নষ্ট হয়ে গেলে বা ঠিকমতো কাজ না করলে এই কাজে ব্যাঘাত ঘটে, ফলে ইঞ্জিন অতিরিক্ত পরিমাণে ফুয়েল খরচ করে। অন্য যেকোনো পার্টস-এর মতো অক্সিজেন সেন্সরেও সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই কিছুদিন পরপর অক্সিজেন সেন্সর চেক করা উচিত।
৫. ভালো রাস্তায় গাড়ি চালান
কেমন রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালানো হচ্ছে তার উপর অনেকটা ফুয়েল এফিশিয়েন্সি নির্ভর করে। গাড়িকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গাড়ির ইঞ্জিন কাইনেটিক এনার্জি তৈরি করে। গাড়ি যদি এবড়োথেবড়ো পথ দিয়ে চালানো হয় তাহলে গাড়ি অনেক বেশি বাউন্স করে এবং এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। তাই ইঞ্জিন ঘনঘন ফুয়েল কনজ্যুম করে। যদিও আপনি রাস্তার কোয়ালিটি ঠিক করতে পারবেন না তবে ঐ রাস্তা দিয়ে আপনি গাড়ি চালাবেন কি না তা অবশ্যই ঠিক করতে পারেবন।
গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার পূর্বেই আপনি কোন রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাবেন তা নির্ধারণ করে ফেলুন এবং অবশ্যই সবচেয়ে ভালো রাস্তাটি বাছাই করবেন। শর্টকাট নিতে গিয়ে খারাপ রাস্তায় গাড়ি চালালে দেখা যাবে আপনার শর্টকাট নেয়ার পরেও জ্বালানি খরচ কমেনি।
৬. অপ্রয়োজনে ইঞ্জিন চালু রাখবেন না
ঘনঘন ইঞ্জিন চালু করলে ফুয়েল বেশি খরচ হয়, এটি সত্য কথা। তবে অপ্রয়োজনে ইঞ্জিন চালু রেখে দিলেও কিন্তু ফুয়েল খরচ বেড়ে যেতে পারে। প্রথমে অল্প অল্প মনে হলেও, মাস শেষে এই খরচ বেশ ভালো পরিমাণে গিয়ে ঠেকে। তাই অপ্রয়োজনে গাড়ির ইঞ্জিন চালু রাখা যাবে না। আপনার যদি মনে হয় যে এখানে বেশি খানিকটা সময় অপেক্ষা করতে হবে অথবা আপনি পার্ক করবেন, তাহলে অবশ্যই ইঞ্জিন বন্ধ করে রাখুন। এতে অল্প অল্প করে অনেকটা জ্বালানি সেইভ করা সম্ভব।
৭. ওভারস্পিডিং করবেন না
যেই রোডেই গাড়ি চালান না কেনো, আপনার নিজের জন্য একটি নির্দিষ্ট স্পিড ঠিক করে নিবেন। আর যদি আপনার ড্রাইভার থাকে তাহলে তাকেও এই স্পিড সেট করে দিবেন। অতিরিক্ত স্পিডে গাড়ি চালালে ইঞ্জিনকে বেশি পরিমাণে ফুয়েল বার্ন করতে হয়। তাই অবশ্যই নিজের জন্য একটি সর্বোচ্চ স্পিড সেট করে নিবেন এবং কোনো অবস্থাতেই সেই স্পিডের উপর গাড়ি চালাবেন না।
৮. অতিরিক্ত ভার বহন করবেন না
গাড়িতে যদি অতিরিক্ত ওয়েট ক্যারি করা হয় তাহলে গাড়িকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে ইঞ্জিনকে বেশি পরিমাণে শক্তি ব্যয় করতে হবে। প্রথমে পার্থক্যটা বোঝা না গেলেও, ধীরে ধীরে দেখা যায় যে ফুয়েল খরচ বেড়ে গিয়েছে। তাই গাড়িতে থাকা যেকোনো প্রকারের অপ্রয়োজনীয় উপাদান বের করে ফেলুন এবং গাড়িকে যতোটা সম্ভব হালকা রাখার চেষ্টা করুন। এর মাধ্যমে আপনার ২% থেকে ৩% জ্বালানি খরচ কমে যেতে পারে।
৯. জেনারেল মেইনটেনেন্স
মানবদেহের মতো গাড়ির’ও রুটিন চেক আপ প্রয়োজন আছে। ছোট ছোট পার্টস অথবা সিস্টেম ঠিক মতো কাজ না করার কারণেও জ্বালানি খরচ বেড়ে যেতে পারে। তাই নিয়মিত মেইনটেনেন্স-এর প্রয়োজন আছে। গাড়ির ম্যানুয়াল অনুযায়ী অয়েল ফিল্টার পরিবর্তন করা, এয়ার ফিল্টার ও স্পার্ক প্লাক চেঞ্জ করা, টায়ারের অ্যালাইনমেন্ট ঠিক করা ইত্যাদি কাজ জেনারেল মেইনটেনেন্স-এর অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও দক্ষ মেকানিক দ্বারা নিয়মিতভাবে গাড়ির চেকাপ করালে চোখের আড়ালে থাকা অনেক সমস্যা বেরিয়ে আসতে পারে যা আপনার জ্বালানি খরচ কমাতে সাহায্য করবে।
১০. এসি বন্ধ রাখা
ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকা বাংলাদেশের সার্বিক তাপমাত্রায় এই নিয়ম মেনে চলা অত্যন্ত কষ্টকর হবে, তা আমরা জানি। বিশেষ করে, ঢাকা শহরের জ্যামে আটকে থাকা অবস্থায় এসি ছাড়া গাড়িতে বসে থাকা যেন প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় এসি চালু রাখা ছাড়া কোনো উপায় নেই। তবে আমরা অনেকেই গাড়ি পার্কিং-এ থাকা অবস্থায় এসি চালু করে রাখি অথবা শীতের মাঝেও অনেকে এসি চালু রাখেন। এতে করে অপ্রয়োজনে জ্বালানি খরচ বেড়ে যায়। জেনে অবাক হবেন, গাড়ির অত্যন্ত ২০% জ্বালানি খরচ হয় এসি সচল রাখার কাজে। এখন আপনিই ঠিক করুন যে, আপনি কখন এসি চালু রাখবেন আর কখন বন্ধ!
১১. অফ-আওয়ারে ড্রাইভ করুন
পিক-আওয়ারে যেকোনো স্থানে প্রচুর পরিমাণে গাড়ির উপস্থিতি কারণে জ্বালানি খরচ বেড়ে যেতে পারে। কেনো? কারণ, জ্যামে আটকে থাকলে এবং ধীরে ধীরে গাড়ি চালালে বেশি এক্সিলেরেট এবং ব্রেক করতে হয়। যার ফলে ইঞ্জিন বেশি পরিমাণে ফুয়েল বার্ন করে। তাই চেষ্টা করুন পিক-আওয়ার এড়িয়ে চলতে এবং অফ-আওয়ারে গাড়ি নিয়ে বের হতে। এতে করে আপনার জ্বালানি খরচ কমবে এবং অতিরিক্ত জ্যামে দুর্ভোগ পোহাতে হবে না।
১২. সকালে জ্বালানি ক্রয়
আগেই বলেছি যে, ঠান্ডা এবং গরম আবহাওয়া ফুয়েল কনজাম্পশনে প্রভাব ফেলে। ঠান্ডা আবহাওয়ায় ফুয়েলের ডেনসিটি বেশি থাকে, যার ফলে খরচ কম হয়। অপরদিকে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে ফুয়েলের ডেনসিটি হ্রাস পায়, ফলে বেশি পরিমাণে ফুয়েল ইঞ্জিনে প্রবাহিত হয় এবং কনজাম্পশন বেড়ে যায়। তাই চেষ্টা করুন সকাল সকাল গাড়িতে জ্বালানি নিয়ে নিতে।
১৩. ফুয়েল-এফিশিয়েন্ট গাড়ি ব্যবহার করা
আপনি যদি অনেক পুরনো মডেলের গাড়ি অথবা হাই-মাইলেজ সম্পন্ন গাড়ি ব্যবহার করেন, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আপনার জ্বালানি বেশি খরচ হবে। তাই জ্বালানি খরচ কমাতে চাইলে কোনো ফুয়েল-এফিশিয়েন্ট গাড়িতে শিফট করার চেষ্টা করুন। আর সম্ভব হলে গাড়ির মডেল আপগ্রেড করুন। কারণ, নতুন নতুন মডেলের গাড়ি সাধারণত আগের মডেলগুলোর তুলনায় বেশি ফুয়েল-এফিশিয়েন্ট হয়ে থাকে।