স্মার্ট বাংলাদেশের অর্থ এই নয় যে স্মার্টফোন হাতে স্মার্টলি ঘুরে বেড়ানো বা সব সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যা খুশি তাই মন্তব্য করা, স্মার্ট বাংলাদেশ হবে এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে মানুষ দেশের যে অঞ্চলেই বসবাস করুক না কেন, সে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা সমতার ভিত্তিতে পেতে পারবে, তখন শহর এবং গ্রামের মানুষের মধ্যে জীবনযাপন এবং সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তেমন কোনো পার্থক্য থাকবে না, ঢাকা শহরের নাগরিক যেমন ঘরে বসেই সব কিছু করতে পারবে, তেমনি প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষও তাই করতে পারবে, যেমন—প্রত্যন্ত গ্রামের একজন নাগরিককে তার পাসপোর্ট নবায়নের জন্য কোনো অবস্থায়ই অন্য কারো দারস্থ হতে হবে না, সে তার গ্রামে বসেই আবেদন করবে, যা প্রযুক্তির মাধ্যমে যাচাই-বাছাই, পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়ে আবেদনকারীর নতুন পাসপোর্ট স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয়ে তার কাছে পৌঁছে যাবে, এখানে ডাক বিভাগের ডেলিভারিম্যান ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির ভূমিকা রাখার প্রয়োজন হবে না, তেমনি আয়কর রিটার্ন দাখিলব্যবস্থা এমন হবে যে মানুষ তার এলাকায় বসে নিজেই রিটার্ন জমা দেবে, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মূল্যায়িত হয়ে প্রযুক্তির মাধ্যমেই অ্যাসেসমেন্ট নোটিশ করদাতার কাছে পৌঁছে যাবে, আয়কর কর্মকর্তার তেমন কোনো ভূমিকার প্রয়োজন এখানে হবে না, তাঁরা অবশ্য স্পষ্টই বুঝতে পারবেন যে কারা আয়কর রিটার্ন জমা দেয়নি, বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশেও গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কেউ চাইলেও কোনো বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে না, কারণ আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তা একেবারে শুরুতেই আটকে যায়, কিন্তু সত্যিকার স্মার্ট বাংলাদেশে খুব সহজেই এটি সম্ভব হবে, যেমনটা উন্নত বিশ্বে হয়ে থাকে, কেননা এসব দেশ সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট দেশে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন যে আগামী ২০৪১ সাল নাগাদ আমাদের দেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ, ডিজিটাল বাংলাদেশের পর স্মার্ট বাংলাদেশের পরিকল্পনা এই শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত, কেননা উন্নত বিশ্বের দেশগুলো তো এরই মধ্যে স্মার্ট দেশে রূপান্তরিত হয়েছে, এমনকি অনেক উন্নয়নশীল দেশও স্মার্ট দেশে রূপান্তরের পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে, তাই দেশের উন্নতি এবং অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে হলে দেশকে অনেকটাই উন্নত বিশ্বের কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে
ভবিষ্যতে যেসব দেশ প্রযুক্তি ব্যবহারে এগিয়ে থাকবে তারাই ব্যবসা-বাণিজ্য, আন্তর্জাতিক লেনদেন এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে, বর্তমান সরকার স্মার্ট বাংলাদেশের মতোই আজ থেকে দেড় যুগ আগে ডিজিটাল বাংলাদেশের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল, ডিজিটাল বাংলাদেশের শতভাগ সফলতা এখনো অর্জিত হতে পারেনি, কিন্তু যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তাতেও বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে, দুই বছর ধরে চলা করোনা মহামারি বাংলাদেশ অনেক উন্নত দেশের চেয়েও যে কম ক্ষয়ক্ষতি মেনে সুন্দরভাবে সামাল দিতে পেরেছে তার অনেক কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল
ডিজিটাল বাংলাদেশের একটি বড় সুবিধা হচ্ছে, দেশের সব কিছু উন্নত বিশ্বের মতো প্রযুক্তিনির্ভর করে তোলা, যাকে এককথায় ডিজিটালাইজেশন বলা হয়ে থাকে, বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তিনির্ভর ডকুমেন্টের গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি, একসময় আমাদের দেশের পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা অনেক দেশেই কম ছিল, সেই পাসপোর্ট যখন সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর মেশিন রিডেবল পাসপোর্টে রূপান্তর করা হলো তখন এর গ্রহণযোগ্যতাও অনেক গুণ বেড়ে গেল
ডিজিটাল বাংলাদেশের বদৌলতে সরকার দেশের সব নাগরিকের জন্য ন্যাশনাল আইডি (এনআইডি) চালু করেছে, যেহেতু এনআইডি সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর একটি ডকুমেন্ট, তাই এর গ্রহণযোগ্যতা শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়, দেশের বাইরেও অনেক বেশি, কিছুদিন আগে এখানকার সরকারি অফিস থেকে আমার কাছে এনআইডির কপি চেয়ে বসেছিল এবং সেই কপি জমা দেওয়ার কারণে আমাকে অনেক আনুষঙ্গিক কাগজপত্র জমা দিতে হয়নি, অথচ এরাই আগে আমাদের দেশের কোনো কাগজপত্রই খুব সহজে বিশ্বাস করতে চাইত না, এখানেই ডিজিটাল বাংলাদেশের গুরুত্ব এবং সুবিধা, আবার বর্তমান যুগে সব কিছু ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপান্তর না করতে পারলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে কী মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয় তার বড় উদাহরণ আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাত
দেড় যুগ আগে ডিজিটাল বাংলাদেশের সূচনা হলেও আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাত সেভাবে প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠতে পারেনি, বিচ্ছিন্নভাবে একেক ব্যাংক একেক রকম প্রযুক্তির ব্যবহার করছে ঠিকই, কিন্তু তাতে প্রকৃত ডিজিটাল ব্যাংকিং থেকে আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাত অনেক দূরে, আজ বিশ্বের নামকরা সব ব্যাংক যে আমাদের দেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ব্যাবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করছে তার কয়েকটি সুনির্দিষ্ট কারণের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে উপযুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহারে আমাদের ব্যাংকগুলোর পিছিয়ে থাকা, ডিজিটাল বাংলাদেশের হাত ধরে দেশকে এগিয়ে নিতে হলে বাংলাদেশকে প্রযুক্তি ব্যবহারে অনেক উন্নত হতে হবে এবং সেই উদ্যোগ সফল করতে হলে স্মার্ট বাংলাদেশ এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়োপযোগী এক কর্মপরিকল্পনা, অনেকেই হয়তো বলার চেষ্টা করবেন যে দেশকে প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে নেওয়ার জন্য স্মার্ট বাংলাদেশ নামের স্লোগানের কী প্রয়োজন, প্রয়োজন অবশ্যই আছে, স্মার্ট বাংলাদেশ তো শুধু একটি স্লোগান নয়, আগামী দুই যুগ ধরে চলবে এমন এক বিশাল কর্মযজ্ঞের নাম স্মার্ট বাংলাদেশ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, স্মার্ট বাংলাদেশ বলতে সাধারণ মানুষ কী বুঝবে এবং এটি অর্জিতই বা হবে কিভাবে, এই নতুন কর্মপরিকল্পনার ব্যাপারে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত এসেছে মাত্র, ফলে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে হলে আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে, সরকার যখন স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ তুলে ধরে কোনো পুস্তিকা বা প্রকাশনা বের করবে, তখনই হয়তো এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে, তবে প্রধানমন্ত্রী যে অনুষ্ঠানে স্মার্ট বাংলাদেশের ঘোষণা দিয়েছেন, সেখানে তিনি স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছেন যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে চারটি মূলভিত্তি নির্ধারণ করা হয়েছে এবং এগুলো হচ্ছে স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট সোসাইটি, বর্তমান সরকার তাদের ঘোষিত রূপকল্প ২০৪১ কর্মসূচি বাস্তবায়নের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিয়ে চলেছে এবং এই কর্মসূচির অংশ হিসেবেই স্মার্ট বাংলাদেশ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে বলেই ধারণা করা যায়, তবে সরকারপ্রধান স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে যে চারটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করে অগ্রসর হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন, তাতে স্পষ্টই বোঝা যায় যে দেশের এই চারটি খাতকে সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট খাত হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না,
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, স্মার্ট বাংলাদেশের ঘোষণা দিলেই তো আর স্মার্ট বাংলাদেশের রূপান্তর ঘটবে না, এটি হবে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ, যেখানে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের এবং উপযুক্ত লোকবল নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা আছে, সেই সঙ্গে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে থাকা চাই সঠিক এবং বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ, সরকার সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে এবং এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতা এবং সদিচ্ছার কোনো কমতি থাকবে না, কিন্তু এই বিশাল কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নের দায়িত্বে যাঁরা নিয়োজিত থাকবেন তাঁদের দক্ষতা, দূরদৃষ্টি এবং মুনশিয়ানার ওপরই নির্ভর করবে ২০৪১ সাল নাগাদ সত্যিকার স্মার্ট বাংলাদেশ হবে, নাকি না সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর, না ম্যানুয়াল পদ্ধতির এক এলোমেলো স্মার্ট বাংলদেশ হবে, যেমনটা হয়েছে ডিজিটাল বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, ডিজিটাল বাংলাদেশের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছিল আজ থেকে ১৫ বছর আগে, দেশ প্রযুক্তি ব্যবহারে অনেক দূর এগিয়েছে ঠিকই, কিন্তু প্রকৃত ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে যা বোঝায় তা থেকে দেশ এখনো অনেক দূরে, তাই সত্যিকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে ডিজিটাল বাংলাদেশের পরিপূর্ণতা দিতে হবে সবার আগে এবং এর ওপর ভিত্তি করেই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হবে,
অনেকে ভাবতে পারেন যে ২০৪১ সাল অনেক দেরি আছে, কিন্তু বাস্তব অবস্থা হচ্ছে প্রকৃত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জন্য আগামী দুই দশক মোটেও কোনো দীর্ঘ সময় নয়, কেননা এ জন্য প্রয়োজন হয় প্রায় ২৫ থেকে ৩০ বছরব্যাপী এক মহাকর্মপরিকল্পনা, প্রযুক্তিনির্ভর সফল ব্যবস্থা, তা সে ডিজিটাল বাংলাদেশ বা স্মার্ট বাংলাদেশই হোক, তা নির্মাণের পূর্বশর্ত হচ্ছে নির্ভুল ডাটাবেইস, ১৭-১৮ কোটি জনসংখ্যার একটি দেশের সব বিষয়ের নির্ভুল ডাটাবেইস তৈরি করতেই লেগে যাবে প্রায় ১০ বছর, তা-ও যদি পর্যাপ্ত লোকবল নিয়োগ করা হয়, এ কাজটিই সবচেয়ে কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, কিন্তু এটি করতে হবে নিখুঁতভাবে, সবার আগে, নির্ভুল ডাটাবেইস নিশ্চিত না করায় ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কী অবস্থায় এসেছে তা অনেকেই খুব ভালোভাবে বুঝতে পারছেন, তাই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে না হয় সেই দিকটা খেয়াল রাখতে হবে, নির্ভুল এবং পরিপূর্ণ ডাটাবেইস নির্মাণের পর কমপক্ষে পাঁচ বছর লেগে যাবে প্রয়োজনীয় সব ইন্টিগ্রেটেড এবং কমপ্রিহেনসিভ সফটওয়্যার তৈরি করতে, অনেকেই বলার চেষ্টা করবেন যে ডাটাবেইস তৈরি এবং সফটওয়্যার নির্মাণের কাজ পাশাপাশি চালিয়ে নেওয়া যেতে পারে, সেটা করা যেতে পারে, কিন্তু তাতে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না, কারণ ডাটাবেইসের ধরনের ওপর ভিত্তি করেই মানসম্পন্ন সফটওয়্যার নির্মাণ করা হয়, এরপর সেই সফটওয়্যারের ভুল সংশোধন, প্রয়োগ এবং সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে এর পরিপূর্ণতা দিতে গেলে আরো পাঁচ থেকে ১০ বছর সময় লেগে যাবে, এ কারণেই আগামী ২৫ বছরের মতো সময় লেগে যাবে সত্যিকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে।
https://bangla-bnb.saturnwp.link/%e0%a6%86%e0%a6%ac%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%93%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%be-%e0%a6%b8%e0%a6%82%e0%a6%95%e0%a6%9f-%e0%a7%a8%e0%a7%a6%e0%a7%a8%e0%a7%aa-%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a7%87-%e0%a6%95/
উন্নত বিশ্ব প্রযুক্তি ব্যবহারে আজ যে পর্যায়ে এসেছে তার কাজটা শুরু করেছিল আজ থেকে ৩০ বছর আগে, তার পরও এসব দেশ যে শতভাগ প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে গেছে এমন দাবি করার সময় এখনো আসেনি, সেই বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী সঠিক সময়েই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন, এখন প্রয়োজন এর কাজ শুরু করে এই উদ্যোগকে সফলভাবে এগিয়ে নেওয়া।